কথা হচ্ছিল গবেষক ড. মাহবুবুল হকের সঙ্গে। বাঙালি হয়েও অপ্রয়োজনে যারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন তাদের সম্পর্কে তার মন্তব্য, ‘অনেকে ভাবেন বিদেশি ভাষা ব্যবহার করলে জাতে উঠা যাবে!’ ঔপনাসিক হরিশংকর জলদাসের ভাষায়, ‘আমরা কথা বলবো বাংলায়, গান গাইবো বাংলায়, গালি দিব বাংলায়, শ্রদ্ধা জানাবো বাংলায়, কাঁদবো-হাসবোও বাঙালির মতো করে।’
মন্তব্য দুটি এদেশের দুই গুণীর ব্যক্তির। দুজনই এবার পেয়েছেন একুশে পদক। সর্বস্তরের বাংলার প্রচলনে করণীয় নিয়ে কথা হলো তাদের সঙ্গে। জয়নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ।
ড. মাহবুবুল হক, গবেষক
একুশে পদকপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক জয়নিউজকে বলেন, আমাদের বিদেশি ভাষার প্রতি একটা অন্যরকম আকর্ষণ আছে। অনেকে ভাবেন বিদেশি ভাষা ব্যবহার করলে জাতে উঠা যাবে। সেজন্য তারা বিয়ের আমন্ত্রণ পত্রে বাংলা ব্যবহার না করে ইংরেজি ব্যবহার করেন।
পরিচয়পত্র-ভিজিটিং কার্ডে বাংলা ব্যবহার না করে অনেকে ইংরেজি ব্যবহার করেন উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, বিদেশ গেলে ইংরেজি কার্ডের দরকার। কিন্তু বিদেশে না গিয়ে বাংলাদেশেও ইংরেজি ভাষার কার্ড ব্যবহার করাকে আমার কাছে হীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়।
সাইনবোর্ডে বাংলার ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য ভাষার ব্যবহার থাকতে পারে, কিন্তু বিভিন্ন ফলকে অবশ্যই বাংলা ব্যবহার করা উচিত। অন্য ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে লেখা যায়।
হরিশংকর জলদাস, ঔপনাসিক
সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলনে করণীয় জানতে চাইলে একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস জয়নিউজকে বলেন, প্রথমে এটার জন্য যেটা দরকার, তা হলো মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভালোবাসা দুই রকম, একটা কৃত্রিম-লোকদেখানো, আরেকটা অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আসলে যারা প্রশাসনের উপরের মহলে আছেন, তাদের মধ্যে এক ধরনের বাড়তি আবেগ জেগে উঠে। সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের জন্য তারা নানা প্রস্তুতি নেন। নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়, সরকারিভাবে দেওয়া হয় অনুদান। আবার ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেলেই এই আবেগ শেষ হয়ে যায়। এই ধরনের আবেগ-ভালোবাসাকে আমি কৃত্রিম ভালোবাসা বলে মনে করি।
তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, ভবিষ্যতেও বলব, দেশের ভাষার প্রচলন ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। অনেকে দেশের উন্নতির জন্য দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা কিংবা সঠিক সময় আসার দোহাই দেন। এগুলো অবশ্যই জরুরি। আমার কথা হলো, কেউ কিন্তু কখনো বলে না সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আর মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় সংস্কৃতি বিকাশ সম্ভব নয়। তাই শুধু সাংস্কৃতিক বিকাশই নয়, সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষা প্রচলনের বিকল্প নেই।
প্রমিত বাংলা ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে এই ঔপনাসিক বলেন, এখনকার তরুণরা কথা বলার সময় ৫০ ভাগই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। আর সেই ইংরেজিও বলে অশুদ্ধভাবে। আর বাংলায় যা কথা বলে তার অধিকাংশই বিকৃত উচ্চারণে।
ইংরেজির গুরুত্বও অস্বীকার করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশের বাইরে যখন আমরা পা রাখি, তা শিক্ষা, বাণিজ্য বা সাংস্কৃতিক, যে কারণেই হোক না কেন, ইংরেজিতেই কথা বলতে হয়। তাই ইংরেজির অবশ্যই দরকার আছে। তবে কখনো ইংরেজিকে বাংলার ওপর স্থান দেওয়া উচিত নয়। বরং বাংলাকে ইংরেজির ওপর স্থান দিতে হবে।
সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইংরেজির ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু ব্যবসায়িক সাইনবোর্ডই নয়, হাসপাতালের যে বোর্ডগুলো আছে সেখানে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়। কেন, হাসপাতালে যারা আছে তারা কি বাংলা বোঝে না? দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজি ব্যবহার হয়। কেন, দোকানের ক্রেতারা কি বাংলা বোঝে না? এই প্রবণতা ছাড়তে হবে। আর ছাড়ার জন্য চর্চা বাড়াতে হবে।
অভিভাবকরা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলা শুধু রাষ্ট্র ভাষা নয়, এটা মাতৃভাষাও। তাই আমরা কথা বলবো বাংলায়, গান গাইবো বাংলায়, গালি দিব বাংলায়, শ্রদ্ধা জানাবো বাংলায়, কাঁদবো-হাসবোও বাঙালির মতো করে।
শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনোয়ারুল ইসলাম জয়নিউজকে বলেন, ভাষার মাস আসলে আমাদের মাঝে বাংলা নিয়ে আবেগের প্রকাশ দেখা দেয়। কিন্তু সারা বছর বাংলার খোঁজ থাকে না। আমরা বন্ধুরা যখন কথা বলি তখন বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলি। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইংরেজি জানার দরকার আছে। তবে আগে মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাদিয়া কানিজ জয়নিউজকে বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া দরকার। পাশাপাশি এতে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা নিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করলে হবে না। সারা বছরই এটা নিয়ে কাজ করা উচিত। বিশেষ করে রেডিও উপস্থাপকদের (আরজে) বিকৃত বাংলা উচ্চারণ বন্ধ করার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের নীতি-নির্ধারকদের ভূমিকা রাখতে হবে।