দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন যাত্রীর পায়ুপথ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে স্বর্ণের বার। শুধু স্বর্ণ নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাচালানকারীদের পায়ুপথে মিলেছে ইয়াবাও। পায়ুপথে কীভাবে বহন করা হয় ইয়াবা-স্বর্ণ? ধরা পড়েই বা কীভাবে? সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জয়নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মনির ফয়সাল।
জামাল উদ্দিন ভেবেছিলেন পায়ুপথে কে আর পরীক্ষা করবে, তাই ওই পথেই নিয়ে আসা যাক স্বর্ণের বার!
বেরসিক কাস্টমস কর্মকর্তাদের তা বোঝাবে কে! জামালের আচরণ দেখে তাদের সন্দেহ হলো। চললো তল্লাশি, এক্স-রে। ফলাফল- পায়ুপথে মিলল ২৪ লাখ টাকার ৬৮০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার!
চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিমানবন্দরে পায়ুপথে স্বর্ণের চালান ধরা পড়ার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। শুধু বিমানবন্দরেই নয়, সীমান্ত এলাকা থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র এখন চোরাচালানের অন্যতম প্রধান মাধ্যম পায়ুপথ।
শুধু স্বর্ণের বারই নয়, ইয়াবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যও এখন এই পন্থায় চলছে চোরাচালান।
যেভাবে পায়ুপথে চলে পাচার
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে পাচারকারী মুখে ইয়াবাগুলো গিলে ফেলেন। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেগুলো পেটেই থেকে যায়। পরে ‘চেকপোস্ট’ পার হলে পায়খানার মাধ্যমে সেগুলো বের করে দেন।
আবার অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ টিউবের মাধ্যমে মলদ্বার দিয়ে এসব ইয়াবা পায়ুপথে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এই কৌশলটি স্বর্ণ চোরাচালানের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে। বিমানবন্দর কাস্টমস বা সীমান্তে ইমিগ্রেশন পার হলে পায়ুপথ থেকে ওই স্বর্ণের বার বের করে আনা হয়।
চিকিৎসকদের বক্তব্য, এভাবে ইয়াবা-স্বর্ণ পাচার স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি পাচারকারীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
যেভাবে ধরা পড়ে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত গোপন সূত্রে খবরের ভিত্তিতে এসব পাচারকারীকে আটক করা হয়। এছাড়া যাত্রীর আচরণ বা শারিরীক অঙ্গভঙ্গি দেখে সন্দেহ হলে তাকে তল্লাশি করে অথবা এক্সরে মেশিনের মাধ্যমেও চালানের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়।
পায়ুপথে আলোচিত কিছু চোরাচালান
২০১৮ সালের ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শারজাহ থেকে আসা রমজান আলী নামে এক যাত্রীর পায়ুপথ থেকে ১ কেজি ১৭০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
২০১৮ সালের ১ আগস্ট একই বিমানবন্দরে শারজাহ থেকে আসা সুমন দাশ নামে অপর এক যাত্রীর পায়ুপথ থেকে আটটি সোনার বার উদ্ধার করে বিমানবন্দর কাস্টমস।
২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি সোমবার ভোর রাতে পায়ুপথে লুকিয়ে ৬ হাজার পিস ইয়াবা পাচারের সময় চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের সদস্যরা। নগরের কোতোয়ালি থানার ব্রিজঘাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর নগরের কোতোয়ালি থানার ফিরিঙ্গিবাজার মেরিনার্স রোডের ইয়াকুব নগর লইট্টাঘাট ব্রিজ এলাকা থেকে তিন তরুণের পায়ুপথে ১ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর ভারতে পায়ুপথে স্বর্ণ পাচারকালে বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকা থেকে ১২টি স্বর্ণের বারসহ শহিদুল্লাহ নামে এক পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে বেনাপোল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত সার্কেলের কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালের ৫ জুন বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে স্বর্ণের বার পাচারের সময় মহিউদ্দীন নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ১২টি স্বর্ণের বার আটক করেন কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা। ওই যাত্রী কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতে প্রবেশ করার সময় তার শরীর তল্লাশি করে পায়ুপথ থেকে স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ শনিবার (৯ মার্চ) চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৬৮০ গ্রাম স্বর্ণসহ মো. জামাল উদ্দিন (৪২) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। জামাল উদ্দিন পায়ুপথে ওই স্বর্ণ বহন করে নিয়ে আসেন।
প্রশাসন কী বলছে
এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের বিমানবন্দর শাখার সহকারী কমিশনার সায়মা পারভিন জয়নিউজকে বলেন, চোরাচালানকারীরা অনেক সময় পেটের ভিতরে করে স্বর্ণ নিয়ে আসে। তাদের চলাফেরায় এক ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। সন্দেহ হলে আমরা তল্লাশি করি। এছাড়া স্ক্যানিং মেশিনে স্বর্ণ বহনের চিহ্ন ধরা পড়ে। তখন এক্স-রে করে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়।
তিনি আরো জানান, এভাবে স্বর্ণ বহনকারীরা মনে করেন কোনোমতে বিমানবন্দর পার হতে পারলে তার টিকিটের ভাড়া উঠে আসবে। তাদের কাজ হচ্ছে শুধু বহন করা। তবে তারা এর বিনিময়ে বাড়তি কিছু টাকাও পেয়ে থাকেন।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (বন্দর) মো. হামিদুল আলম জয়নিউজকে বলেন, পাচারকারীরা ইয়াবা মুখ দিয়ে খেয়ে পেটের ভিতরে করে নিয়ে আসে। তারা এভাবে ৫০০ থেকে ১ হাজার পিস ইয়াবা বহন করে থাকে।
তিনি আরো বলেন, ইয়াবা পাচারকারীরা মনে করে শরীর তল্লাশি করে কোনোকিছু পাওয়া যাবে না। তাই তারা নিজের শরীরকে পাচারের জন্য বেশি নিরাপদ মনে করে। কারণ যাই খাওয়া হোক না কেন, বের হওয়ার রাস্তাতো একটাই।
আটককৃতদের ওষুধ খাইয়ে ওই ইয়াবা পেটের ভিতর থেকে বের করা হয় বলেও জানান তিনি।