বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ছেয়ে গেছে কালো ধোঁয়ায়। চারদিকে ছড়িয়ে আছে রক্ত, আর ছিন্নভিন্ন দেহ। সহস্র মানুষের আহাজারি। এ যেন এক মৃত্যুপুরী।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার চিত্র এমনই। ‘সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার’ উদ্বোধন ঘোষণার মুহূর্তেই ঘটানো হয় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনাটি।
যাঁকে টার্গেট করে এই হামলা সেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান। যদিও তাঁর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলার সময় শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আরও কয়েকজন মানবপ্রাচীর তৈরি করেন।
শেখ হাসিনা প্রাণে বাঁচলেও ইতিহাসের বর্বরোচিত এই গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমান। নিহত হন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগ কর্মী রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আমিনুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম, মোশতাক আহমেদ সেন্টু, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন ও ইসাহাক মিয়া। বাকি একজনের পরিচয় এখনও অজানা।
আহত হন আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, এএফএম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, মাহবুবা পারভীন, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দীপ্তি, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনিসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন জোট বিএনপি-জামায়াত ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলা ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, এ হামলায় জিয়া পরিবারও জড়িত। ওই হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সংসদে দাঁড়িয়ে উপহাস করেছিলেন। সেই সরকার সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমি নাকি গ্রেনেড ভেনিটি ব্যাগে করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। জোট সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে তদন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব ওমর ফারুক এবং সরকারের পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করিয়েছিলেন। আসলে কোনো তদন্তই করা হয়নি।
জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনার পুনরায় তদন্ত হয়।
গ্রেনেড হামলায় সম্পৃক্ততার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছিলেন সালামের ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন। মামলার অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে শুধু আবদুস সালামই নন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ফের শুরু হয় মামলার তদন্ত। সেই তদন্তে উঠে আসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ৫২ জন। এর মধ্যে ১৮ জন পলাতক। ইতোমধ্যে ২২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। বিশেষ আদালতে চলা মামলায় এখন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের যুক্তিতর্ক চলছে। এরপরই তা রায়ের জন্য রাখা হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ মামলার বিচারিক আদলতের রায় দেওয়া সম্ভব হবে। এ হামলায় দায়ের করা মামলার পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার আইনি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
বারবার টার্গেট শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এর আগেও বেশ কয়েকবার পরিকল্পনা করেছিল ঘাতকেরা। কিন্তু প্রতিবারই ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। এরপর তিনি আদালতে দুই দফায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিবরণ দেন।
মুফতি হান্নানের জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজি-বির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই বছরের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। তবে সমাবেশের আগে পুলিশ তা উদ্ধার করে ফেলে।
২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি-বি। তখন ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু হামলার আগেই জনসভাস্থলের অদূরে বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গিদের দুই সদস্য নিহত হওয়ায় জঙ্গিদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আবু সাইদ ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর সিলেট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করেন।
২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি-বি। অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদীতে দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১৫ হুজি সদস্য ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটি আর সফল হয়নি। এই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভা বানচাল করতে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। এটি পরে ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ নামে পরিচিতি পায়। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদাসহ ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
জঙ্গিদেরও আগে ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট রাতে ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চালায়। শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় এ হামলা চালানো হয়েছিল। এ অভিযোগে ঢাকার ধানমন্ডি থানায় দুটি মামলা হয়। মামলা দুটির বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
আল্লাহ বাঁচিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে
আপা ভাষণ শেষ করার ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁর পেছন দিকে গা ঘেঁষে অবস্থান নিই। জয়বাংলা বলে উনি ভাষণ শেষ করতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ ওনাকে (শেখ হাসিনা) বসানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি বসতে চাচ্ছিলেন না। বরং ‘কী হলো, কোথায় আওয়াজ’ বলে আশপাশে দেখার চেষ্টা করলেন। তবে পরক্ষণেই তাঁর কাঁধে ধরে অনেকটা জোর করেই ট্রাকের পাটাতনের ওপর ভাষণমঞ্চ হিসেবে রাখা টেবিলটিকে আড়ে রেখে তাঁকে বসিয়ে দিই। প্রথম পর্যায়ে আমি ও মোহাম্মদ হানিফ (আওয়ামী লীগ নেতা) এবং পরে আরও কয়েকজন নেতা আপাকে ঘিরে রাখি।
যে গ্রেনেডটি ট্রাকের ডালায় পড়ে গড়িয়ে নিচে পড়েছিল, সেটি পাটাতনে পড়লে আপাসহ আমরা সবাই মারা যেতাম। মানবপ্রাচীর তৈরি করে আমরা যাঁরা ওনাকে ঘিরে রেখেছিলাম, তাতেও তিনি রক্ষা পেতেন না। একমাত্র আল্লাহই তাঁকে বাঁচিয়েছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময়কার ঘটনা এভাবেই বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার (ফিজিক্যাল প্রটেকশন) দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আবদুল্লাহ আল মামুন।
আবদুল্লাহ আল মামুনের শেষ কথাটাই সত্যি ‘আল্লাহই বাঁচিয়েছেন শেখ হাসিনাকে’। একের পর এক যেভাবে টার্গেট করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে তাতে এতদিন ওনার বেঁচে থাকার কথা ছিল না।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন কিন্তু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। দেশের দূর গ্রামের দুর্গম ইউনিয়নেও এখন লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া।
বুক ভরা সাহস আছে বঙ্গবন্ধুকন্যার। সঙ্গে আছে সহস্র কোটি বাঙালির ভালোবাসা। এই সাহস আর ভালোবাসার কারণে দেশের অনেক ভয়াবহ সমস্যা তিনি মোকাবেলা করেছেন সহজেই।
সহস্র প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের উন্নয়নের স্রোত চলমান রাখতে প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। দেশের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। রাজাকার, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। দীর্ঘজীবী হউক বঙ্গবন্ধুকন্যা, এ কামনাই করে স্বাধীন বাঙালি।