‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যে হাতে মেশিনগানে শুট করেছিলাম, যুদ্ধের পর সেই হাতে ক্যামেরা দিয়ে শুট করা শুরু করি। মুক্তিযুদ্ধে যখন যোগ দিতে যাই তখন সেখানে একটি ফরম পূরণ করতে হয়েছিল। সেখানে একস্থানে লেখা ছিল মুক্তিযুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরলে কোন পেশায় যাবো। কিছু না ভেবেই সেখানে সাংবাদিকতা লিখে দিয়েছিলাম। কারণ এই একটি পেশাতেই মানুষের জীবনের খুব কাছে যাওয়া যায়। মানুষের জীবনের হাসি-কান্না ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে তুলে আনা যায়।’
এভাবেই জয়নিউজের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ ও পরবর্তীতে নিজের ফটোগ্রাফার হওয়ার গল্প তুলে ধরেন চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু।
১৯৭১ সালে তিনি সেক্টর-১ এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেক্টরে তাঁর ক্রমিক নাম্বার ছিল ২১৬৬৯। সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় একদিন প্রখ্যাত পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা হয়। তখন তিনি তাঁর ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ছবি তুলছিলেন। সেই ঘটনাটি আমার মনে দাগ কাটে। সেদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিই যদি যুদ্ধের পর বেঁচে থাকি তাহলে আমিও ফটোগ্রাফার হব।’
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমরা ব্যাটারিগলি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলাম। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ডাক আসার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে হানাদার পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যা ও ধর্ষণযজ্ঞ। আমার এলাকাতে চার নারীকে ধর্ষণ করে পাকহানাদার বাহিনী। তাদের বাসা আমাদের পাশাপাশি ছিল।’
মঞ্জু বলেন, ‘আমাদের ঘরে আমার দুই বোন ছিল। তাদের তখন বয়স ছিল ১৪ ও ১৬ বছর। আমি ভাবলাম এভাবে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। যুদ্ধে যেতে হবে। ওই চার নারীর ধর্ষণ আমার মনে জেদ তৈরি করে। আমার মনে ভয় ছিল হানাদার বাহিনী একদিন আমাদের ঘরেও হানা দেবে। তাই কাউকে কিছু না বলে বাবার পকেট থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে একদিন রাতে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। যাওয়ার আগে মায়ের কাছে একটি চিঠি লিখে যাই যে আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। হয়ত দেশ স্বাধীন করে ফিরব না হলে দেশের জন্য প্রাণ দেব।’
প্রবীণ এ সাংবাদিক বলেন, ‘মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় বাহিনী) সহায়তায় অবশেষে নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ মিত্রবাহিনী সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে ১৬ ডিসেম্বর সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয় আমরা পেয়ে যাই। যুদ্ধের পর পুরো দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। এরপর আমরা দেশ বিনির্মাণের কাজে লেগে যাই। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্যে দিয়ে আবারো দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়।’
নিজের কর্মজীবন নিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু লক্ষ্য ছিল সাংবাদিক হবো, ১৯৭৯ সালে মাত্র ৫০০ টাকা বেতনে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পত্রিকা নয়াবাংলাতে ফটোসাংবাদিক ও ক্রীড়া প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিই। তখন পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন আবদুল্লাহ আল সগীর। তিনিই আমাকে নয়াবাংলাতে কাজ করার সুযোগ করে দেন। এরপর ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত একটানা এ পত্রিকায় কাজ করি। ওই বছর চট্টগ্রামে দৈনিক পূর্বকোণ নামের একটি আঞ্চলিক পত্রিকা বের করেন ইউসুফ চৌধুরী। তিনিই আমাকে নয়াবাংলা থেকে দৈনিক পূর্বকোণে ফটোসাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে প্রথম দুই বছর পূর্বকোণের ঢাকা অফিসে কাজ করতে হয় আমাকে। পরে ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করি। সেই থেকে দীর্ঘ ৩২ বছর পত্রিকাটিতে কাজ করি।’
তিনি বলেন, ‘এ পত্রিকাতে কাজ করার সময়েই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য, চট্টগ্রাম আবাহনী (হকি) ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডের স্পোর্টস কমান্ডার, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশন চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটিতে তিনবার পরিচালক নির্বাচিত হই।’
নিজের তোলা সবচেয়ে স্মরণীয় ছবির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির আগে ১৯৯৪ সালে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ের মাঝখানে লুকিয়ে একবার সন্তু লারমার ছবি তুলেছিলাম। তিনি তখন তার সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য সেখানে এসেছিলেন। পরের দিন ছবিটি দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত হয়। এরপর সন্তু লারমা ছবিটি দেখে আমার পরিচয় জানতে চান এবং আমাকে ‘ফেয়ার ডেভিল’ নামে আখ্যায়িত করেন। এছাড়া এরপর তার আর কোনো ছবি তুললে পার্বত্য এলাকা থেকে আমাকে মৃত ফিরতে হবে বলে হুমকি দেন। তবে এরপরও লুকিয়ে আমি তার অনেক ছবি তুলি এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৯৬ সালে শান্তিচুক্তির সময় আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং আমার পরিচয় দিই। এছাড়াও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইসিসি মিনি বিশ্বকাপ, ২০১১ সালে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসের ছবি তুলেছি।’
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো মুক্তিযোদ্ধা তার সন্তান বা বংশধরদের কোটার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোটার বিপক্ষে। আমার সন্তান তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই পড়বে কিংবা চাকরি করবে। যদি মেধাক্রম অনুসারে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে হয়তো কোটা ব্যবহার করা যেতে পারে।