একপাশে সারিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে তরুণীরা, তরুণরা অন্যপাশে। সবার সামনেই বড় জলের পাত্র (ড্রাম)। গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তরুণ-তরুণীরা পরষ্পরের দিকে জল ছুঁড়ে মারতে শুরু করলেন। হাসিমুখে একজন আরেকজনের দিকে জল ছুঁড়ে মারছেন। অন্য দর্শনার্থীরা উপভোগ করছেন এ জলকেলি খেলা। একদলের পর আরেকদল যাচ্ছে জলকেলি খেলতে। জলকেলির পর চলছে গানের তালে তালে নাচ।
দৃশ্যটি শুক্রবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে নগরের কাতালগঞ্জের নবপণ্ডিত বিহারের। যেখানে জলকেলির মাধ্যমে পুরাতন বছরের জরাজীর্ণকে পেছনে ফেলে নতুন বছরের যাত্রা শুরু করেছে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষেরা। তাদের ভাষায় যে উৎসবটি সাংগ্রাই নামে পরিচিত।
জলকেলির আগে ভগবান বুদ্ধের সামনে প্রার্থনা, রাখাইন নৃত্য ও বুদ্ধকে পবিত্র জলে স্নান করানো হয়। তারপর শুরু হয় তরুণ-তরুণীদের জলকেলি।
জলকেলিতে অংশগ্রহণ করা তনয়া মারমা জয়নিউজকে বলেন, প্রতিবছর সাংগ্রাই উৎসবে এখানে আসি। শহরে বিভিন্ন কাজ থাকাতে বাড়িতে যেতে পারি না। তাই এখানে এসে সাংগ্রাই উৎসবে জলকেলিতে অংশ নিই।
জানা যায়, মারমা আদিবাসীরা বর্ষবরণের উৎসবকে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে ৩দিন ধরে। মারমাগণ সবাই বুদ্ধের মূর্তি কিংবা ছবি নিয়ে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের জল দিয়ে এটিকে স্নান করান। তারপর আবার এছবিটিকে আগের জায়গায় অর্থাৎ মন্দির বা বাসাবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মারমা সম্প্রদায় সেই আদিকাল থেকে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে আসছে, যা মারমা ভাষায় সাংগ্রাই নামে পরিচিত। মূলত
‘সাক্রাই’ (সাল) শব্দ থেকেই ‘সাংগ্রাই’ শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যা বাংলায় ‘সংক্রান্তি’ বলে পরিচিত। মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই জ্যা’র (মারমা বর্ষপঞ্জি) গঠনের মাধ্যমে সাংগ্রাইয়ের দিন ঠিক করা হয়ে থাকে। মাইংমা ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকেই এ ‘সাক্রাই’ বা সাল গণনা করা হয়, যা ‘জ্যা সাক্রই’ নামে পরিচিত।
সাংগ্রাইয়ের উৎপত্তি নিয়ে মারমা ভাষায় বিভিন্ন কল্পকাহিনী বিদ্যমান রয়েছে, যা এখনো মারমা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত। কবে থেকে মারমাদের সাংগ্রাই উদযাপন শুরু হয় এ ব্যাপারে সঠিক কোনো ইতিহাস এখনো পাওয়া যায়নি। সাংগ্রাই উৎসবটি মারমারা তিন দিনব্যাপী উদযাপন করে। সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় ‘সাংগ্রাই আক্যা’ বা ‘পাইং দোয়াক’ (সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন পুষ্প আহরণ)। দ্বিতীয় দিনকে ‘সাংগ্রাই বাক্’ (সাংগ্রাইয়ের দিন) এবং তৃতীয় দিনকে ‘সাংগ্রাই আপ্যাইং’ (সাংগ্রাই বিদায়) নামে পরিচিত। এই তিন দিন মারমারা নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে।
এদিনে আসন্ন পবিত্র সাংগ্রাইকে সামনে রেখে মারমারা নিজেদের বাড়ি, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের রাস্তা পরিষ্কার করে। এদিন মারমারা সবাই মিলে পবিত্র সূত্রাদি পাঠের মাধ্যমে বিহার পরিষ্কার করে থাকে। এদিনে খুব ভোর থেকে গ্রামে গ্রামে মারমাদের মধ্যে নিজ নিজ উদ্যোগে পুষ্প আহরণের ধুম লাগে। এদিন যে যত বেশি পুষ্প আহরণ করে বুদ্ধের কাছে পুষ্পপূজা করতে পারবে সে তত বেশি পূণ্য অর্জন করবে বলে মারমাদের বিশ্বাস। সাংগ্রাইয়ের তিন দিনকে উপলক্ষ করে অনেকে বিহারে গিয়ে তিন দিনের জন্য অষ্টশীল পালন করে উপাসনা করেন। আবার অনেকে এদিন খুব ভোরে বিহারে গিয়ে বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে ‘অংরুং ছোইং’ (ভিক্ষুদের সবার খাবার) দান করেন। বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষুরা এদিন ধর্ম দেশনা দিয়ে থাকেন। দুপুর গড়ালে ‘দোয়াইং’ (ভিক্ষুদের দুপুরের খাবার)-এর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। অতঃপর ভিক্ষুদের দোয়াইং গ্রহণ শেষ হলে বিকেলে ‘নাইংসা’ (সুগন্ধিকাব বিশেষ)-এর পানি, ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ স্নান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এরপর জলকেলিতে মেতে ওঠে রাখাইন তরুণ-তরুণীরা।
রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মং হ্লা চিং জয়নিউজকে বলেন, রাখাইনদের নতুন বছরের উৎসবকে সাংগ্রাই বলা হয়। এদিন জলকেলিতে মেতে ওঠে রাখাইন তরুণ-তরুণীরা। মূলত পুরাতন বছরের দুঃখ-কষ্ট-গ্লানিকে পানি দিয়ে ধুয়ে নতুন বছরের শুরুর জন্যই এ জলকেলি উৎসব।
কাতালগঞ্জ নবপণ্ডিত বিহারের অধ্যক্ষ উপানন্দ মহাথের জয়নিউজকে বলেন, নতুন বছরকে বরণ করার জন্য প্রত্যেক আদিবাসী সমাজের আলাদা আলাদা উৎসব রয়েছে। ত্রিপুরাদের বৈসুক, রাখাইনদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজুর প্রথম অক্ষর নিয়ে বৈসাবি উৎসব। প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এবারও আমাদের বিহারে সাংগ্রাই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। নবপণ্ডিত বিহারে এবার সাংগ্রাই উৎসবের ১২ বছর পূর্তি হয়েছে। আগামীতেও আমরা এ উৎসবের আয়োজন করব।