দুই দফা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর নিরাপত্তাহীনতা এবং আবারও হামলার আশঙ্কায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত কনসার্ট বাতিল করে স্টেজ গুটিয়ে নিয়েছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ।
শনিবার (১৩ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর থেকে কনসার্টের সমস্ত আয়োজন গুটিয়ে নিয়ে যায় স্পন্সর প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ এবং কোমলপানীয় প্রতিষ্ঠান মোজো। দুই দফা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে তাদের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শুক্রবার (১২ এপ্রিল) রাত ১টার দিকে ছাত্রলীগের একটি অংশ এসে এই আয়োজনে ভাঙচুর চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। তারপর এ নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এতে সাগর নামে স্যার এফ রহমান হল ছাত্রলীগের এক কর্মী আহত হন। এ বিরোধের জের ধরে পুনরায় শনিবার সকাল ৮টার দিকে দুটি বাইকে চারজন এসে পেট্রোল ঢেলে কনসার্টের সাউন্ডবক্সে আগুন দিয়ে যায়। এ ঘটনায় পুনরায় হামলা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আয়োজকরা। সকাল থেকেই তারা কনসার্টের সমস্ত আয়োজন গুটিয়ে নেয়।
ঘটনাস্থলে সরেজমিনে দেখা যায়, মল চত্বরের সীমানা প্রাচীর ও আশপাশে লাগানো কনসার্টের ব্যানার-ফেস্টুন ছেঁড়া, কোনোটি আগুনে পোড়া। কনসার্টের মূলমঞ্চ এলোমেলো, পাশে মেলার স্টলগুলোর তাবু উল্টে আছে। এরপাশে কাঠ ও বাঁশে আগুন লাগানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি ফ্রিজ ভেঙে পড়ে আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আতিকুর রহমান খান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমান, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইউসুফ উদ্দীন খান, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আরিফ হোসেন, অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এহসান উল্লাহ, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী ও স্যার এফ রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তুষারের নেতৃত্বে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তারা সবাই ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের অনুসারী।
জানা যায়, বৈশাখী কনসার্টের এই আয়োজন সম্পর্কে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে জানানো হয়নি। অন্য তিন নেতা সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাবি সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে এ কনসার্ট আয়োজন করা হয়। এতে শোভনের অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হল থেকে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যান। ক্যাম্পাসে একটা উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করে।
এ বিষয়ে ডাকসুর জিএস ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, যারাই এ কাজ করেছে, তাদের বিচার করা হবে। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস অভিযোগ করে বলেন, মল চত্বরে যারা ছিল, তাদের সবাই দেখেছে। ছাত্রলীগ সভাপতি শোভনের কর্মীরা ওই কাজ করছে। তার (শোভন) নির্দেশেই এটা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা পহেলা বৈশাখের কনসার্টে বাধা দেয়, তারা অন্তত স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে পারে না। এর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিচার দাবি করেন তিনি।
ডাকসুর এজিএস ও ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত ১৩ ও ১৪ এপ্রিলের অনুষ্ঠান যেন সুন্দরভাবে হয়, সেজন্য আমরা কাজ করব।
তবে অনুসারীদের হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি ঘটনার পর জানতে পেরেছি। এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির সঙ্গে কেন্দ্রের তো একটি সমস্যা আগে থেকেই আছে। অন্যদিকে, ডাকসুর সঙ্গে ছাত্রলীগের মোড় তৈরি করে আমাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ডাকসু ও ছাত্রলীগের মনমালিন্যের কারণে এই বিষয়টা রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হচ্ছে।
ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর কনসার্ট বাতিল ও নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন কোমলপানীয় প্রতিষ্ঠান ‘মোজো’র অপরেশন ব্যান্ড হেড মার্কেটিং বিভাগের প্রধান আজম বিন তারেক।
তিনি বলেন, মধ্যরাতে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটার পর আমাকে অনেক অনুরোধ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সবকিছু ‘আন্ডার কন্ট্রোলে’ থাকবে। তাই আমি সবকিছু গুছিয়ে পুনরায় কাজ করা শুরু করলাম। সকাল ৮ টার দিকে চারজন লোক হেলমেট পরে এসে আমাদের সাউন্ড বক্সে (যার দাম তেতাল্লিশ লক্ষ টাকা) পেট্রোল দিয়ে আগুন লাগিয়ে চলে যায়। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের প্রায় ১ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় এখানে থাকা আর সম্ভব নয়। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি, তাই এখানে কনসার্ট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে সকালে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের আশ্বাসে শুধু কনসার্ট চালিয়ে যাবার কথা বললেও বিকেলে সেটাও বাতিলের কথা জানা যায়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কনসার্টের সবধরণের সরাঞ্জামাদি গাড়ি ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং স্টেজ ছাড়া আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই।
মোজোর সিকিউরিটি ফোর্সের এক কর্মকর্তা বলেন, সব নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে কনসার্ট বাতিল। এখন শুধু স্টেজের জিনিসগুলো বাকি আছে। এগুলোও একটু পরে নিয়ে যাওয়া হবে। এই মুহুর্তে কেউ কনসার্ট হবে বলে দাবি করলেও কোনো লাভ নেই। এটা এখন সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদার বলেন, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম সবাইকে একটা সুন্দর কনসার্ট উপহার দেওয়ার জন্য। কিন্তু যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, আমার প্রকাশ করার মতো ভাষা নাই। তবে আমি এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি সবকিছু ঠিকঠাক মতো করছিলাম কিন্তু এখানে পেট্রোল দিয়ে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা লজ্জাজনক।
কনসার্ট বাতিল করা হয়েছে বা কারা আগুন দিয়েছে এমন তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জানা আছে কি-না এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, এটা শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রাম। তারাই সিদ্ধান্ত নিবে এটা আয়োজন করা হবে কি হবে না। আর কারা আগুন দিয়েছে এটা আমরা দেখছি।
সহকারী প্রক্টর আবদুর রহিম সাংবাদিকদর বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।