এসেছে বাঙালির বৈশাখ। জয়নিউজের সকল পাঠক, দর্শক, শ্রোতা, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের জানাই শুভ নববর্ষ। জয়নিউজের পরামর্শক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজীব নন্দী’র কলমে চট্টগ্রামের বর্ণিল বৈশাখী আবাহন-
ইট-কাঠ-কংক্রিটের নগর চট্টগ্রাম। নগরজুড়ে ব্যস্ততা আর কোলাহল। এই নগরে কোলাহল আরো বেড়ে যায়, যদি উৎসবের উপলক্ষ হাজির হয়। তেমনই একটি উপলক্ষ বর্ষবরণ। উনিশ শতকের শহুরে বাঙালির তৈরি করা সেক্যুলার উৎসব পহেলা বৈশাখ, যতটা না শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান এর চেয়েও বেশি লৌকিক আচার।
নগরবাসীর কাছে এই উৎসব মানুষে মানুষে সম্মিলনের অন্যতম উপলক্ষ। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিসি হিলের নজরুল মঞ্চ থেকে সমবেত কণ্ঠে শোনা যায় ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’র সুর। অগ্নিস্নানে এই ধরণীকে শুচি করতে ওরা গায় বর্ষবরণের গান। অশ্রুবাষ্প মুছে নতুন বছরকে বরণ করতে নগরবাসীর কাছে এই আহ্বান জানানো হয়। সকাল থেকেই নগরবাসী ছুটে বেড়ায় প্রাণের উৎসবে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূলকেন্দ্র ডিসি হিল। নগরবাসী কবিগুরুর মতো কেবল ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ বলে আহ্বানই করে না, নজরুলের সেই ‘এলোকেশে ঝড় অকালবৈশাখী’ হানা দিচ্ছে কি-না সেটাও ভাবে।
ডিসি হিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। যে আয়োজন চলে আসছে ১৯৭৩ সাল থেকে। এছাড়া সিআরবি’র শিরিষতলায় সাত রাস্তার মোড়, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি চত্বর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ক্যাম্পাসজুড়ে চলে বর্ষবরণের বর্ণিল আয়োজন। নাগরিক ইট-কাঠ-কংক্রিটের ভিড় ঠেলে তিন পার্বত্য জেলার নববর্ষ বরণেও থাকে নানা আয়োজন। সবমিলিয়ে নববর্ষ চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে অন্যরকম মাত্রা যোগ করে।
পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে শুরু হয় হালখাতা। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী টেরিবাজার ও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করিয়ে ক্রেতার সঙ্গে হালখাতার মাধ্যমে মেলবন্ধন আরও সুদৃঢ় করেন।
নগরের বর্ষবরণে অন্যতম আকর্ষণ শিশু-কিশোরদের বিদ্যাশিক্ষার পাঠশালা সহজপাঠ ফুলকীর আয়োজন। বৈশাখের প্রথম দিবসে শিশু-কিশোরদের নানান অনুষ্ঠানে মহাসমারোহ বয়ে যায় এখানে। নগরের মহিলা সমিতি স্কুলের মাঠেও থাকে বর্ষবরণ মেলা।
চবিতে নববর্ষ আয়োজন উত্তর চট্টগ্রামের অন্যতম উৎসব। আয়োজনের মাত্রা এবং ব্যাপকতায় এটি সবার কৌতূহলের কেন্দ্রে থাকে। নগর থেকে কিছুটা দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যারা বর্ষবরণ করতে চান তারা এসে মাতোয়ারা হন এই ক্যাম্পাসে। পাহাড়-ঝরনা আর সমতলভূমির এই ক্যাম্পাসের বর্ষবরণে থাকে লোকজ সংস্কৃতির সমাহার। বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উৎসবে সামিল হন সাবেক শিক্ষার্থীরাও। নগর থেকে বাহারি শাটল ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে ফিরতে হয় সেই রাতে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা আদিবাসী সম্প্রদায় বৈশাখ উদযাপন করে বৈসাবি নামে। এখানে অন্যতম উৎসব মারমাদের জলকেলী। এই দিনে মিষ্টান্নের সঙ্গে থাকে নানা স্বাদের ও বৈচিত্র্যের পাহাড়ি খাবার।
চৈত্রের শেষ প্রহরে, মানে বাংলা বছরের শেষ দিনটির পর উৎসবের শুরু হয় চট্টগ্রামে। সেই বর্ষবরণের পর্দা নামে বলীখেলার মাধ্যমে। চট্টগ্রামের ভাষায় কুস্তিকে বলা হয় বলীখেলা। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে মেলা। কোটি টাকার বাণিজ্য হয় এ মেলায়। মুড়ি-মুড়কি থেকে শুরু করে খাট-পালং সবই পাওয়া যায় এখানে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের আবদুল জব্বার সওদাগর শুরু করেন এ খেলা। বাঙালি যুবকদের ইংরেজবিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনে সুদক্ষ কর্মীবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য লালদীঘি ময়দানে চালু করা হয় বলীখেলা। এটি চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নতুন জোয়ার নিয়ে আসে। ফলে লালদীঘি ময়দানে জব্বারের বলীখেলা হয়ে ওঠে দেশপ্রেমিক জনসাধারণের দীক্ষাগ্রহণের মঞ্চ।
চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে তরুণ থেকে মধ্যবয়সীরাও অংশ নিতেন বলীখেলায়। এতে দেশপ্রেমের মন্ত্রণা দেওয়াই ছিল বড় কাজ, জয়-পরাজয় তো ছল কেবল। ব্রিটিশ সূর্য অস্তাচলে, পাকিস্তানি বাহিনী লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে, বিদেশি শত্রু নেই, বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন ভূমি। তাতে কী? এখনো জব্বার মিয়ার বলীখেলা আর লালদীঘির মেলা উদ্দাম, মুখর। উপলক্ষ বদলে গেলেও বাঙালির উৎসবের তালিকায় যুক্ত হয়ে গেছে এ মেলা আর বলীখেলা। এ মেলা শেষ হওয়ার মধ্যদিয়ে চট্টগ্রামে শেষ হয় পনের দিন ধরে চলা বর্ষবরণ!
একটা সময় ছিল যখন গ্রামীণ এই উৎসবগুলো ছাড়া নগরজীবন কল্পনাও করা যেত না। বৈশাখের মেলার জন্য সেই বর্ষা থেকেই প্রস্তুতি। শরৎ-হেমন্ত-গ্রীষ্মজুড়ে চলে কেনা এবং বেচা’র দুই দলেরই আয়োজন। ভরদুপুরের ঘুমের আগে বৈশাখীমেলায় যাওয়ার স্বপ্ন বা গল্প হতো শয্যাসঙ্গী। বর্ষবরণ উৎসবে অচেনা হাজারো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে কল্পনার এক জগৎ তৈরি হতো সবার। বছর বিদায় নিতো, বছর আসতো সেখান থেকেই।
বিশ্বায়িত সংস্কৃতির প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মেলা। গোটা সংস্কৃতির মধ্যেই যখন এর প্রভাব পড়ছে, বর্ষবরণও বাদ নেই। গান, নাটক, কবিতা পাঠ, খেলাধুলাসহ নানা বিচিত্রানুষ্ঠান চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে পাড়া-মহল্লায় ও গ্রামেই বেশি দেখা যেত। এখন বাস্তবের মেলার চাইতেও টেলিভিশনের পর্দার মেলা অনেককেই টানে। এসব সাংস্কৃতিক উৎসব-চালচলনের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী টান ছিল, সেই দিন আর নেই।
দিন বদলে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বৈশাখী উৎসব বা নববর্ষ পালনে দিনে দিনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। বাঁশির জায়গা দখল করেছে ভিনদেশি ভুভুজেলা। হারিয়ে যাচ্ছে হাতকাঠির ভেল্কি ঢাকের শব্দ। মালকোচা ধুতি পড়ে একবাদ্যে তারা ঢাক পেটান, ঢাকি নামেই যাদের ডাকি! সেই ঢাক আর তেমন একটা বাজে না বর্ষবরণে। আগে যারা মাতিয়ে রাখতেন এই বর্ষবরণের দিনটি; এখন সেসব ঢাকিরা সারাবছর নিরবে কেঁদে চলেন। সবার অলক্ষ্যে একটি দীনহীন জীবনই সম্বল যেন তাদের। পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছর এলেও তাদের ভাগ্যাকাশে আসে না কোনো ভাগ্যদেবী!
নাগরিক বর্ষবরণে আবেগের চেয়ে আয়োজনের পাল্লাই ভারি। বাণিজ্য আর করপোরেটের সর্বগ্রাসী থাবা সুকুমার উৎসবগুলোতেও। বহুজাতিক কোম্পানি আর মনোলোভা পণ্যের বিজ্ঞাপনে এখন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে মুনাফা খুঁজে বেড়ায়। বিলবোর্ড আর সাইনবোর্ডের বিজ্ঞাপনের চাপে লুকিয়ে থাকে মানুষের সমবেত উপস্থিতি। খুব ধীরে হলেও খেয়াল করা যায়, বর্ষবরণ তার জৌলুস আর নিজস্বতা হারাচ্ছে এসব উৎসবে।
সেই যে বাঙালির শেষ আশ্রয় কবিগুরু বৈশাখের আবাহনে উচ্চারণ করেছিলেন ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’; গ্রীষ্মের দাবদাহ নিয়ে বৈশাখের আগমন মানেই ‘জীর্ণ পুরাতন’ গোটা পুরনো একটা বছর শেষ করে আর একটি বছরে প্রবেশ। চট্টগ্রামের বাঙালির কাছে বৈশাখের অর্থই নতুনকে বরণ করে নেওয়া।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।