কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের মধুরছড়া এলাকার মো. ইকবাল হোসেন মিয়ানমারের বুতিদং এলাকায় স্কুল শিক্ষকতা করতেন। ২০০৯ সালে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর থেকেই কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে আছেন। এখানে কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়াই রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার স্কুলে তিনটি শিফটে ৯০ জন শিক্ষার্থী। কোনো সাইনবোর্ড নেই। তবুও নাম দিয়েছেন হোলি চাইল্ড আইডিয়াল প্রাইভেট সেন্টার। সেখানে পড়তে এসেছে আসমা আক্তার। তার ইচ্ছে একদিন ক্যাম্পে বিদেশিদের জন্য দোভাষীর কাজ করবে।
আসমা বলে, আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। এখানে আবার পড়া শুরু করেছি। এখানে আমি ইংরেজি পড়ছি।
কারণ হিসেবে নাজমা জানায়, বাইরে থেকে যখন ভিজিটর আসে, বড়লোকরা আসে, ওরা তো আমাদের রোহিঙ্গা ভাষা বুঝে না। এজন্য আমি যদি ইংরেজি শিখি, ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবো। কারও কারও কথা অনুবাদও করতে পারবো।
লাজুক এই মেয়েটি জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জীবন কঠিন। তবুও নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা তার থেমে যায়নি।
তার সহপাঠী কবির আহমেদ। কবির শিক্ষক হতে চায়। কবির জানায়, আমি এখানে আসছি লেখাপড়া করবো বলে। নিজে লেখাপড়া করে আমার মতো আরেক ভাইকে লেখাপড়া শেখাবো।
এদের স্বপ্নকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছেন তাদের শিক্ষক মো. ইকবাল হোসেন।
তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম আসি তখন দেখি আমার মতো এখানে অনেক পরিবার আছে। কিন্তু এখানে কোনো স্কুল নেই। আমি এখানকার জন্য কি করতে পারি তা চিন্তা করছিলাম। আমার মনে হলো, যদি আমরা এই অবস্থাতেই থাকি, আমাদের ছেলে-মেয়েরা দিনদিন বড় হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া না করলে ওদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
কক্সবাজারে সরকারি হিসেবে যে ৩০টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে সেখানে নতুন ও পুরানো মিলিয়ে শরণার্থী শিশুর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের মতো। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে আরো ৬০টি করে শিশু। কিন্তু এই শিশুদের জন্য সেই অর্থে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তবে এখানে রোহিঙ্গারা নিজেরা বেশ কিছু আরবি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন।
মধুরছড়ায় বাঁশ দিয়ে বানানো একটি ঘরে একজন মৌলভী সাহেব আরবি পড়াচ্ছিলেন। তিনি এখানে এসেছেন গত বছর। তিনি জানান, দ্বীন ইসলাম রক্ষা করবার জন্য এটা বানিয়েছেন। কুতুপালং ক্যাম্পে কিছুদূর পর পর চোখে পড়ে চিহ্নিত শিশুবান্ধব এলাকা ও লার্নিং সেন্টার নামে কিছু ব্যবস্থা। যেখানে শিশুদের খেলাধুলা, বার্মিজ ও ইংরেজি বর্ণমালা ও প্রাথমিক সংখ্যা জ্ঞান শেখানো হয়। বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এগুলো পরিচালনা করছে। কিন্তু অভিভাবকরা আরও বেশি কিছু চান। যেমনটা বলছেন সফুরা বেগম।
তিনি বলছেন, আমাদের স্কুল নেই। ফলে আমাদের যে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আছে, তারা পড়াশুনা করতে পারছে না। আমাদের যদি বার্মায় ফিরে যেতে হয়, তাহলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া লাগবে। বার্মিজ পড়ার জন্য, ইংরেজি পড়ার জন্য এখানে শিক্ষকও নেই, স্কুলও নেই। এটা আমাদের জন্য খুব দরকার। ছেলে-মেয়েরা যে বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। একবছর আগে পালিয়ে এসে নিজেই একটি আরবি শেখানোর মক্তব খুলেছি।
সফুরা বেগম বলেন, আমরা যদি আবার বার্মায় ফিরে যাই, ওখানে আমাদের কাজ করতে গেলে বার্মিজ এবং ইংলিশ দুটিই জানতে হবে। এজন্য আমাদের তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ দেওয়ার জন্য শিক্ষক দরকার। কক্সবাজারে আগে আসা রোহিঙ্গা ছেলে-মেয়েদের অনেকে স্থানীয় স্কুলে পড়ে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করেছে কয়েকটি স্কুল।
কক্সবাজারে সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা ড্যাফনি কুক বলছেন, এটা খুবই উদ্বেগের যে একটি প্রজন্ম শিক্ষা ছাড়া বেড়ে উঠছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করেন অভিভাবকরা।
ড্যাফনি কুক বলেন, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় অসাধারণ কাজ করছে। এরমধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য শিক্ষা। তবে ক্যাম্পে অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্র যা রয়েছে তা যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, আমরা আনুষ্ঠানিক কিছু চাই। যা শিশুরা ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারবে। আমরা দেখছি শিশুরা, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকরা বিষয়টা নিয়ে হতাশ। আমরা চাই এর একটা পরিবর্তন হোক।-বিবিসি বাংলা
জয়নিউজ/আরসি