যুবক মার্ক্সের বেশ কিছু কবিতা আছে। সেগুলোর গভীরতা, দীপ্তি ও চমকের পেছনের মূল শক্তি জেনির প্রতি মার্ক্সের প্রেম-কাতরতা। কার্ল মার্ক্স এর প্রেমিকা, সহধর্মিণী, আট সন্তানের জন্মদাত্রী জেনি মার্ক্স (জেনি ভন ভেস্তফ্যালেন) আসলেই অনালোচিত অনন্যসাধারণ একজন নারী। তরুণ কবি মার্ক্স তরুণী জেনিকে নিয়ে এম্নি এম্নি লিখেননি—“Truly, I would write it down as a refrain/ For the coming centuries to see—/ Love is Jenny, Jenny is love’s name.”
মার্ক্স তার চেয়ে চার বছরের বড় অভিজাত ধনীকন্যা জেনিকে কৈশোর-যৌবনে যে’রকম ভালবেসে ছিলেন, জেনিও মার্কসকে তেমনই ভালবেসে ছিলেন। নিদারুণ অভাব-অনটন, দেনার চাপ, একের পর এক সন্তানদের অকাল মৃত্যুর সব কষ্টকে স’য়েও জেনি-মার্ক্সে এর ভালবাসা জেনির মৃত্যুদিন পর্যন্তও প্রায় একই রকম ছিল। জেনির মৃত্যুর পর মূষড়ে পড়া, অসুখে পড়া মার্ক্সও বাঁচলেন মাত্র আঠারো মাস।
জেনি ছিলেন মার্ক্স-এর সহযোদ্ধা, মূল ছায়া, আশ্রয়— ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। ১৮৫১ সালে গৃহকর্মী মিম্মি (হেলেন ডেমুথ) পিতাহীন পুত্রসন্তান জন্ম দেবার পর যখন পিতাকে প্রশ্নে সকলের আঙ্গুল মার্ক্স-এর দিকে, এঙ্গেলস তখন দাবি করলেন তিনিই ডেমুথের সন্তানের পিতা। এখনো যেমন সন্দেহ আছে যে এঙ্গেলস বন্ধুকে বদনামের হাত হতে বাঁচাতে পিতৃত্বের দাবি নিয়ে এসেছেন, তখনো সন্দেহটি ছিল। জেনি নিশ্চয়ই মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছিলেন সেই সময়টিতে। তবুও ঘটনাটি তাদের দাম্পত্যে ছেদ পড়ার কারণ হয়নি।
জেনির মতই অনন্য সাধারণ মার্ক্সের পিতা হাইন্রিখ। সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহি মার্ক্সকে আইন পড়তে পাঠানোর অপরাধবোধ হতে কি-না কে জানে যুবকপুত্র মার্ক্সকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, রাগ-উষ্মা-ক্ষোভ-হতাশা ঝেড়ে চিঠি লিখতেন। সেই চিঠিগুলোতে থাকত বিশৃঙ্খল তারুণ্যের বেগতিক অবস্থা হতে মার্ক্সকে আয়-উপার্জনে ফেরানোর উপদেশ-আর্তি, বাস্তববাদী হবার পরামর্শ, জেনির যোগ্য হয়ে ওঠার, জেনির পরিবারে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার উপায়-পদ্ধতি। হাইনরিখ একবার উল্লেখও করেছেন লেখালেখি তাঁর ভাল লাগেনা তবুও পুত্রের যাতে ভাল হয় সেজন্য অবিরাম লিখছেন। মার্ক্স ও বাবাকে রাগ, অভিমান, ক্ষোভ উগরে লিখতেন। জেনির বাবা কেন তাকে আর পছন্দ করছে না জেনি কেন তাকে চিঠি লেখা বন্ধ করেছে সে’সবও ক্ষ্যাপা মার্ক্স বাবার উপরই ঝাড়তেন।
পিতা হাইন্রিখের ছিল সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখার দায়, প্রেমিকা জেনির ছিল প্রিয়তমকে স্বপ্নগামী রাখার দায়। দুজনের এই আপ্রাণ চেষ্টার ইতিবৃত্ত কিন্ত নাটক, সাহিত্য বা ইতিহাসে ভালভাবে উঠে আসেনি, অথচ স্ক্যান্ডাল-এর ইঙ্গিত থাকায় মার্ক্স-এংগেলস-মিম্মি (পিতাহীন সন্তানের মা) বিষয়ে নাটক, গল্প, উপন্যাস, ব্রডওয়ে শো নেহাত কম নেই।
John Spargo’র Karl Marx: His Life and Work ১৯১২তে লেখা একটি সুখপাঠ্য বই। তার ঠিক ১০০ বছর পর ২০১২ সালে আরেকটি সুখপাঠ্য বই Love and Capital: Karl and Jenny Marx and the Birth of a Revolution ছাপা হল। মার্ক্সকে নিয়ে অসংখ্য লেখা আছে, অনেক পড়াও যাবে। স্পার্গোর বইয়ের পুনঃ পাঠের পাশাপাশি মেরি গ্যাব্রিয়েলের ‘লাভ অ্যন্ড ক্যাপিটাল পাঠে অনেক পাঠকই আনন্দ পাবেন।