সত্যজিতের ফেলুদা, তোপসেরা দশাশ্বমেধ লজে উঠেছিল না? ঠিক সেই লজের পাশেই এখন নতুন গজিয়ে উঠেছে আরো মন্দির। সেই মছলি বাবার ডেরা যাওয়ার রাস্তাটি? হ্যাঁ, এখনো হুবহু আছে। অপরাজিতা সিনেমার ব্রাহ্মণ হরিহরের সেই দশাশ্বমেধ ঘাট? ওটাও আছে। সব দেখতে চাইলে ঘুরে আসুন কাশী তথা বারাণসী। দেখবেন, মছলিবাবার ডেরা গলি দিয়ে কতদূর গেলেই মগনলাল মেঘরাজ আপনাকে সাদরে সম্ভাষণ জানাচ্ছে! সবই হবে ভারতে বারাণসীতে। যার আদি নাম কাশী!
ভারতের বারাণসী বা বেনারসকে বলা হয় ইতিহাসের জননী, ঐতিহ্যের মাতামহী। কাশীর রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে বেনারসী ঘরানার হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত বিকাশ লাভ করে। কাশী বিখ্যাত মূলত বিশ্বনাথ মন্দিরের জন্য। প্রতি ভোর পৌনে তিনটায় মন্দিরের দরজা খোলে। পাঁচ জন মোহান্ত একসঙ্গে এক ঘণ্টার অভিষেক করে বিশ্বেশ্বরের ঘুম ভাঙান। আলসে আড়মোড়া ভেঙ্গে ভোর চারটে নাগাদ খেয়ালি বিশেশ্বর সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হন। ততক্ষণে গলি বেয়ে বয়ে গেছে মাইল দুয়েক লম্বা লাইন।
বিশ্ববিখ্যাত বারানসীর কথা কম-বেশী আমরা সকলেই জানি। বরুণা ও অসি এই দুই নদীর সংযোগস্থলে গড়ে ওঠা বারানসীর মূখ্য আকর্ষণ হল ঘাট। ৮৮ টি ঘাটের মধ্যে পাঁচটি মুখ্য ঘাট হল অসি ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট, হরিশ্চন্দ্র ঘাট, কবির ঘাট। প্রত্যেকটি ঘাট বিশেষ বিশেষ মাহাত্ম্য নিয়ে অবস্থান করছে। সর্বপ্রধান ঘাট দশাশ্বমেধ ঘাট; কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সবচেয়ে কাছাকাছি ঘাট। পুরানমতে ভগবান ব্রহ্মা তাঁর দশটি অশ্ব দান করেন এইখানে।
বারানসীর ঘাটে সর্বদা তীর্থযাত্রীদের ভীড় চোখে পড়ার মতো। এটি একমাত্র ঘাট যেখানে জীবন-মৃত্যু একসাথে দেখা যায়। রোজ সকালে প্রাতঃপ্রনাম, সূর্যোদয় দেখে একাধারে জীবন শুরু হয়। অন্যদিকে হরিশ্চন্দ্র-মণিকর্ণিকা শ্মশান হিসেবে পরিচিত। দেশী-বিদেশী মানুষের ভীড়ে সর্বদা প্রানবন্ত হয়ে থাকে বারানসীর ঘাট। এই ঘাটের মূখ্য আকর্ষণ হল সন্ধ্যাকালীন গঙ্গারতি। শত শত প্রদীপের আলোয় সেজে ওঠে ঘাট। নিত্য নৈমিত্তিক এত বিপুল আয়োজনে গঙ্গারতি অন্য কোথাও পাওয়া যায়না। শীতকালে তাড়াতাড়ি সূর্যাস্তের কারণে সন্ধ্যা ছয়টায় এবং অন্য সময় সন্ধ্যা সাতটায় গঙ্গারতি হয়। হাজার হাজার দর্শনার্থীদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, যুক্তি-তক্কো সব মিলেমিশে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্ট হয়।
বিচিত্র ধরনের লোক দেখা যায় এই ঘাটে। কেউ ল্যাংটা সাধু, কেউ ছত্রি খুলে বসেছেন মানুষের ভাগ্যবিচার করতে, খুদে বাচ্চারা এক হাঁটু জলে নেমে মানুষের নদীতে ফেলে দেওয়া কয়েন কুড়াতে ব্যস্ত, কেউ বা দড়ির মাথায় খাবার দিয়ে মাছ ধরছে অনন্য এক কৌশলে। তার মাঝে ধবধবে সাদা রঙা কিংবা বিকট কালো বিদেশিদের আনাগোনা তো চলতেই থাকে। আরোও আছে অঘোরী সাধু। বর্তমানে বারানসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গারতির ক্ষুদ্র সংস্করনের দেখা মিলবে পশ্চিমবঙ্গের তারাপীঠে। তারামায়ের মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দ্বারকানদেও করা হবে একই নিয়মে গঙ্গারতি। ইতিমধ্যে তার যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেই পরিকল্পনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ধূপ-ধুনার গন্ধে মাতাল করা গঙ্গারতি এবং নৌকায় চড়ে গঙ্গা-ভ্রমন সব মিলিয়ে বেনারসের ঘাট এক আকর্ষণীয় ভ্রমনস্থান। বাঙালির সাংস্কৃতিক রাজনীতি সে দিনও বারাণসীর এই সর্বভারতীয় চিহ্নগুলি চিনতে চায়নি, আজও! চিনলে বুঝত, এ শহর গঙ্গার স্রোতের মতোই গতিময়।
বারাণসী মানে বাঙালি চোখের বালি-র বিনোদিনী, কিংবা পথের পাঁচালী। কখনো জয় বাবা ফেলুনাথের দশাশ্বমেধ ঘাট কিংবা কেদারনাথ মন্দির। কখনো আবার বাঙালির বিশ্বাস- কাশীতে মরলে মোক্ষলাভ। বাঙালি ঠিকই জানে বারাণসীতে শিবের ত্রিশূলের ডগায় আয়েশ করে বসে আছেন ফেলুদা, মগনলাল মেঘরাজের দিকে মগজাস্ত্র ছুড়ে বলছে- জয় বাবা বিশ্বনাথ!
লেখক: শিবানী মণ্ডল, গবেষক, বানারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, ভারত