চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। ঋণখেলাপি থেকে শুরু করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কানেকশন, অনেক অভিযোগই আছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তিনি জেল খাটছেন তিন বছর ধরে। জানা গেছে, জেল থেকেই এই আলোচিত রাজনীতিক চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে কলকাঠি নাড়ছেন। বিস্তারিত জানতে পড়ুন মুহাম্মদ জুলফিকার হোসেনের বিশেষ প্রতিবেদন
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। ২০১৪ সালে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী কারাগারে আছেন তিন বছর ধরে। অন্যদিকে সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল হাছান মারা গেছেন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এরপর থেকে একরকম নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় আছে উত্তর জেলা বিএনপি।
তাই বলে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেমে আছে এমনটা বললে ভুল হবে। জাতীয় দিবসে উত্তর জেলার কর্মসূচি থাকে সবসময়। ঘরোয়া বৈঠক কিংবা কেন্দ্রের নির্দেশে মিছিল মিটিংও হচ্ছে নিয়মিত। তবে সবকিছুই হচ্ছে দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে।
জেল থেকেই মনিটরিং, সাংগঠনিক নির্দেশনা
উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকেই আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী ও সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল হাছানের অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আসলাম জেলে ও হাছান মারা যাওয়ার পর এই দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়েছে।
এখন প্রায় প্রতিটি দলীয় কর্মসূচিই পৃথক পৃথকভাবে পালন করা হয়। থানাগুলোতে রয়েছে দ্বৈত কমিটি। সাম্প্রতিক অতীতে দুই নেতার অনুসারীরা প্রকাশ্যে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন।
জানা গেছে, উত্তর জেলার আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিক আসলাম চৌধুরী কারাগার থেকেই মূল কলকাঠি নাড়ছেন। আসলাম জেল থেকেই তার বিশ্বস্ত অনুসারীদের মাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করছেন। জেলে বসেই তিনি কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সাংগঠনিক সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।
যদিও আসলামের এই একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব আবদুল্লাহ আল হাছানের গ্রুপ। হাছান মারা গেলেও তার অনুসারীরা মাঠ ছাড়েননি। আহ্বায়ক আসলামের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে পৃথকভাবে তারা পালন করে দলীয় কর্মসূচি।
আসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক
পেশায় ব্যবসায়ী লায়ন আসলাম চৌধুরী ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনোনীত হন। এর আগে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। তবে গত তিন বছর ধরে জেলে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত এই রাজনীতিক।
বর্তমানে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় কারাগারে আছেন আসলাম চৌধুরী। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে যোগসাজশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে ২০১৬ সালের ১৫ মে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু এই একটিই নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবি ব্যাংকসহ ২৭টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ থাকায় চট্টগ্রাম-৪ আসনে আসলামের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়।
এছাড়াও সীতাকুণ্ড উপজেলাসহ উত্তর জেলার বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, নাশকতাসহ নানা অভিযোগে বেশ ক’টি মামলা রয়েছে আসলামের বিরুদ্ধে। এজন্য তাকে জেলেও যেতে হয় একাধিকবার।
আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই ৫ বছর!
নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে আসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও আবদুল্লাহ আল হাছানকে সদস্য সচিব করে গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। ওই কমিটির কাজ ছিল যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা। একইসঙ্গে থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের সব কমিটিও করে দিতে বলা হয়েছিল ওই কমিটিকে।
এই কমিটি করতে গিয়েই যত বিবাদের সূচনা। আহ্বায়ক-সদস্য সচিব দুই গ্রুপই পৃথক পৃথক কমিটি দিতে শুরু করে। শুরু হয় কোন্দল আর গ্রুপিং। যার ফলশ্রুতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী নির্ধারণের ক্ষেত্রেও দলের শীর্ষ নেতাদের যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয়। যাদের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাদের সবার প্রতি ছিল না ঐক্যবদ্ধ দলীয় সমর্থন। পরে নির্বাচনে সাতটি আসনের প্রতিটিতেই বড় ব্যবধানে হারে বিএনপি জোট।
পূর্ণাঙ্গ কমিটি কখন- জানেন না কেউ!
উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়েছে পাঁচ বছর হলো। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগের দেখা মেলেনি। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মাহবুবুর রহমান শামীম গণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার কমিটি গঠনের ব্যাপারে দলের চিন্তাভাবনার কথা বললেও তা কথার কথাই থেকে গেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আগের কমিটির যুগ্ম সম্পাদক, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন জয়নিউজকে বলেন, ২০১৪ সালে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সে সময় যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় সেখান থেকে সদস্য সচিবসহ চার-পাঁচজন এরমধ্যেই মারা গেছেন। আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী আছেন কারাগারে। তাই দলের সাংগঠনিক কাজে গতি আনতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।
কবে নাগাদ কমিটি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম ভাই ওমরাহ করতে গেছেন। উনি আসলে এ বিষয়ে বৈঠকের কথা রয়েছে।
বড় নেতারা আগ্রহী নন ‘ছোট ব্যাপারে’
চট্টগ্রাম উত্তর জেলার বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে। তবে তাদের কমিটি গঠন বা দলীয় কোন্দল নিরসনের বিষয়ে কথা বলতে দেখা গেছে খুব কম।
খালেদা জিয়া সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন ও তার ছেলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের বাড়ি হাটহাজারীতে। দলের অপর ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক কূটনীতিক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খন্দকার থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা রাজনীতি করেন উত্তর জেলাতেই। কিন্তু তাদের কাউকেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে এখন পর্যন্ত সেভাবে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।