মেঘের গর্জন, ভারি বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, ঘোলা পানি- সবকিছু মিলিয়ে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় শনিবার (২৫ মে) রাতে হালদা নদীতে রুই জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা মাছ ডিম ছাড়ে। প্রায় দেড় মাস ধরে ডিম সংগ্রহের অপেক্ষায় নৌকা, জাল ও বালতিসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে হালদাপাড়ে অপেক্ষায় ছিলেন শত শত ডিম সংগ্রহকারী। এ লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসনও বেশ তৎপর ছিল।
হালদা নদীতে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মা মাছ সংরক্ষণে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ, ঘেরা-ভাসা জাল ও ইঞ্জিনচালিত নৌযান এবং ড্রেজার ধ্বংস করা হয়। এছাড়া ডিম থেকে রেণু তৈরির কুয়া সংস্কার, কুয়ায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাসহ নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ।
শনিবার রাত পৌনে ৯টা থেকে হালদার চারটি পয়েন্টে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। রাত ১২টার দিকে পূর্ণমাত্রায় ডিম ছাড়ার পর ডিম সংগ্রহকারীরা জাল ফেলে ডিম সংগ্রহে নেমে পড়েন। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত শত শত মৎস্যজীবী ২ শতাধিক নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ করেন। তবে উপজেলা প্রশাসনের ব্যাপক তৎপরতার পরও আশানুরূপ ডিম মেলেনি হালদায়।
এ বছর সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ আগের বছরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। ২০১৮ সালে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল প্রায় ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। এর আগে ২০১৬ সালে প্রায় ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম আহরিত হয়। তবে এ বছর শুধুমাত্র ৭ হাজার কেজি ডিম সংগৃহীত হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আশানুরূপ ডিম আহরণ করতে না পারায় হতাশ ডিম সংগ্রহকারীরা।
গত ৫ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এপ্রিলে মা মাছ সাধারণত প্রথম দফায় ডিম ছাড়ে। এরপর মে ও জুনে দ্বিতীয় দফায় ডিম ছাড়ে। ২০১৭ সালে ২২ এপ্রিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালের ২ মে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল প্রথম দফা ও ১৩ জুন দ্বিতীয় দফায় ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ১৬ হাজার ৫০০ কেজি এবং ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ৪ হাজার ২০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
এবার আশানুরূপ ডিম না পাওয়ায় ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে হতাশার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। হালদাপাড়ের এক ডিম সংগ্রহকারী জানান, এ বছর ডিমের পরিমাণ অনেক কম। আগের বছরের (২০১৮) তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। মাত্র ৭ হাজার কেজির মত হবে। অথচ ১০ বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গত বছর হালদা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম। ওই বছর আমরা প্রতি নৌকায় সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৮ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলাম। সে তুলনায় আমরা এ বছর একেবারে শেষ হয়ে গেছি। যদি সংগৃহীত ডিম ঠিকভাবে পরিস্ফুটন করা যায়, তাহলে হয়তো কোনোরকমে খরচটুকু উঠবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, শনিবার রাতে জোয়ার আসার পর মা মাছ ডিম ছাড়ে। তবে পরিমাণে একেবারেই কম। কারণ অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে হালদা থেকে বালু উত্তোলন, ঘেরা-ভাসা জাল দিয়ে মা মাছ নিধন, ইঞ্জিনচালিত নৌযান ও ড্রেজারের পাখার আঘাতে অনেক মা মাছের মৃত্যু এবং রুই জাতীয় মা মাছের অবাধ বিচরণে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া অপরিকল্পিত রাবার ড্যাম, পাহাড়ে তামাক চাষ, হালদায় বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাথরের ব্লক ও এপ্রিল মাসের দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হওয়ায় এমনটা হয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় মা-মাছ ডিম ছাড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবারে তিনি বলেন, সম্ভাবনা খুবই কম।
এ ব্যাপারে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমীন বলেন, হালদায় নিবিঘ্নে মা মাছ যাতে চলাচল করতে পারে অবৈধ মাছ শিকারীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ করেছি। গত সাত মাসে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট বালু, ১ লাখ ৩০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করেছি। ধ্বংস করা হয়েছে ৫টি ড্রেজার, ৮টি বালু উত্তোলনকারী ইঞ্জিনচালিত নৌকা। জরিমানা আদায় হয়েছে নগদ ৫০ হাজার টাকা। দুইজনকে একমাস করে কারাদণ্ড এবং জব্দ করা বালু নিলামে বিক্রি করে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, মাছুয়াঘোনা, শাহ মাদারি এবং মদুনাঘাটসহ ৩টি হ্যাচারির ১০৮টি কংক্রিট ও ১০টি প্লাস্টিকের কুয়ায় হালদার ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। তবে সংস্কারের অভাবে এসব কুয়ার ৪৫টি নষ্ট হয়ে যায়। দেড় মাস আগে নষ্ট হওয়া কুয়াগুলো আমরা সংস্কার করেছি। ডিম ফোটানোর কাজে সহযোগিতার জন্য সরকারি তিনটি হ্যাচারির ১১৩টি কুয়া প্রস্তুত আছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মাটির তৈরি ১৪১টি কুয়াতেও চলছে ডিম ফোটানোর কাজ। প্রয়োজনে আরও কুয়া তৈরি করে দেবে উপজেলা প্রশাসন। হালদায় ডিম সংগ্রহকারীদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছি এবং দিয়ে যাব।
তিনি বলেন, আমি বেশ ক’জন ডিম সংগ্রহকারীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মতে, হয়তো গত বছরের চাইতে ডিম কম পেয়েছি, তবে এর আগের তিন-চার বছরের চাইতে ভালো পেয়েছি। এছাড়া হাটহাজারী অংশে তিন হ্যাচারির প্রায় ৩০-৫০ জন ডিম সংগ্রহকারীর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, এবারের ডিমের কোয়ালিটি ভালো।