অপরাধের অন্ধকার থেকে কয়েদিদের আলোর পথে নিয়ে আসতেই কারাগার। কারাফটকে ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ স্লোগান সেই আদর্শ ও উদ্দেশ্যকেই ধারণ করে।
কিন্তু সেই কারাগারের ভেতরেই যখন ঘটছে একের পর এক অপরাধ, তখন সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। গত ২৯ মে অপর এক বন্দির হাতে শীর্ষসন্ত্রাসী অমিত মুহুরী খুনের ঘটনায় এ প্রশ্ন আরো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
তবে চট্টগ্রাম কারাগারে খুনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৯৮ সালে কারাগারে আরেক শীর্ষসন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা আলমকে গলায় ব্লেড চালিয়ে খুন করেছিলেন আরেক বন্দি। এরপর ২০০০ সালে ভারতীয় নাগরিক জিবরান তায়েবী হত্যা মামলার আসামি ওসমানকে ছুরিকাঘাতে খুন করেছিল অপর এক বন্দি। সর্বশেষ গেল ২৯ মে খুন হয় শীর্ষসন্ত্রাসী অমিত মুহুরী।
যেভাবে আলম হত্যা
যুবলীগ নেতা আলমের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ১৯টি মামলা ছিল। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে ১৯৯৭ সালের ১৪ আগস্ট তাকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ৯ মে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে দিনদুপুরে আলমকে গলায় ব্লেড চালিয়ে খুন করে আরেক বন্দি কেলা কাদের। সেসময় আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত খুন দাবি করে আলমের অনুসারী ও তার পরিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেছিল। পরে কেলা কাদেরকে আসামি করে কারা কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করে।
আলম খুনের ঘটনায় গঠিত হয়েছিল তদন্ত কমিটিও। সেই কমিটি খুনের কোনো সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি। তবে কেলা কাদেরকে হত্যাকারী চিহ্নিত করা হয় চার্জশিটে। পরে আলম হত্যায় কাদেরকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তবে হাইকোর্টে আপিল করে জামিনে বেরিয়ে যান কেলা কাদের। কাদের যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাকা চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলমের বড় ভাই মো. জাকির জয়নিউজকে বলেন, কারাগারে আলম হত্যার আসামি কেলা কাদেরের বিরুদ্ধে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয় আদালত। পরে হাইকোর্টে আপিল করে সে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে আমরা উচ্চ আদালতে মামলা এগিয়ে নিতে পারিনি। যে কারণে খুন করেও মুক্তি পেয়ে যায় কাদের।
তিনি আরো বলেন, কারাগারে একটা কাঁচামরিচ ঢুকতেও কত নজরদারি পেরিয়ে যেতে হয়। আমার প্রশ্ন হলো- কীভাবে আমার ভাই হত্যায় ব্যবহৃত গ্লাস কাটার ছুরি কারাগারে যায়? কীভাবে মুহুরী হত্যায় ব্যবহৃত ইট বা ছুরি কারাগারে যায়? আসলে সব টাকার খেলা।
একই কায়দায় খুন অমিত মুহুরীও
গত ২৯ মে ২১ বছর আগের ঘটনার যেন পুনারাবৃত্তি ঘটল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৩২ নম্বর সেলে আরেক কয়েদি রিপন নাথের ইটের আঘাতে খুন হয় অমিত মুহুরী।
এদিকে অমিতের পরিবারের দাবি কারা কর্তৃপক্ষ শুরুতে নিজেদের বাঁচাতে ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করে। প্রাথমিকভাবে কারাগারে চিকিৎসা দিয়ে গোপনে অমিতকে সুস্থ করার চেষ্টা চালান কারা হাসপাতালের চিকিৎসকরা। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে কারা হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে চমেক হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কারাগার থেকে অমিতকে রাত ১১টায় বের করা হয়। ততক্ষণে অমিতের মৃত্যু হয়।
অমিতের বাবা অরুণ মুহুরী জয়নিউজকে বলেন, জেলখানায় অমিতকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে এবং পুরো জেলখানার কর্মকর্তারা এতে জড়িত আছেন। কোটি টাকার লেনদেনে খুন করা হয়েছে আমার ছেলেকে। জেলখানা তো নিরাপত্তার জায়গা। সুরক্ষিত রাখার জন্য জেলখানাটা দেওয়া। আদালত তাকে ফাঁসি দিলে আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু এভাবে তাকে মেরে ফেলবে এটা কেমন কথা! কারাগারে এত বড় ইট কীভাবে আসে?
কারা কর্তৃপক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে অরুণ মুহুরী বলেন, অমিতকে কে মারল? আমাদেরকে সঙ্গে সঙ্গে খবরটা দিলো না কেন? অমিতকে জেলখানায় মেরে ফেলার পর মেডিকেলে আনল কেন? আনল, তাও নিচে ফ্লোরে ফেলে রেখেছিল।
জানা যায়, অমিতের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১৫টি মামলা আছে। তার বিরুদ্ধে আছে পূর্বাঞ্চল রেলের কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনের মামলাও। এর আগে ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট নগরের এনায়েতবাজার এলাকার রানীরদিঘি এলাকা থেকে একটি ড্রাম উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে বোমা রয়েছে ভাবা হলেও ড্রাম কেটে ভেতর থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ গলে যাওয়ায় তখন পরিচয় বের করা যায়নি। পরে এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ৩১ আগস্ট ইমাম হোসেন ও শফিকুর রহমান নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানান, ড্রামের ভেতরে পাওয়া লাশটি অমিতের বন্ধু নগর যুবলীগের কর্মী ইমরানুল করিমের। ৯ আগস্ট নগরের নন্দনকানন হরিশ দত্ত লেনের নিজের বাসায় ইমরানুলকে ডেকে নেন অমিত। এরপর বাসার ভেতরেই তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর অমিতকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী এ এম জিয়া হাবীব আহসান জয়নিউজকে বলেন, আসামি যত দুর্ধর্ষই হোক না কেন, কারাগারে এ ধরনের খুন খুবই দুঃখজনক। আসামিকে নিরাপদে রাখা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। যখন ঘটনা ঘটল, মারামারি হলো তখন কারারক্ষীরা কোথায় ছিল? আর কারাগারে ইট আসল কীভাবে? এটা পরিকল্পিত হত্যার ইঙ্গিত দেয়। তাই পুলিশকে দিয়ে নয়, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে এই খুনের তদন্তের দাবি জানাই আমি।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাধ্যক্ষ নাশির আহমেদ জয়নিউজকে বলেন, কারাগারের সেলে বন্দিরা যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে তখন সবসময় কারারক্ষীরা তা কন্ট্রোল করতে পারেন না। কারণ কারারক্ষীরা তাদের সেলে থাকে না। এখানে নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই।
এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অমিত মুহুরীকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করেছে রিপন নাথ, এ বিষয়ে সেলে থাকা অন্য আসামি বেলাল স্বীকারোক্তি দিয়েছে। রিপন নাথ খুনের পরদিন থেকে কোনো কথা বলছে না। আমরা তাকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছি। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে জেরা করলে সত্য ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এরপর বিচারের কাজ আদালতের।
মামলার তদন্ত সংস্থা চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মিজানুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, অমিত মুহুরী খুনের বিষয়ে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কারণ বলা সম্ভব নয়। তবে কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে খুনে অভিযুক্ত রিপন নাথ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দায় স্বীকার করেছে। তাকে রিমান্ডে এনে খুনের পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি-না তা উদ্ঘাটন করা হবে।