একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার ‘প্রাণ’। যদি প্রশ্ন করা হয়- নিজ প্রাণের চেয়েও মূল্যবান সম্পদ কী? প্রশ্নটা অনেকের কাছেই একটু অন্যরকম মনে হবে। উত্তরটা খুঁজতে বেগও পেতে হবে খানিকটা। কিন্তু প্রশ্নটা যদি করা হয় একজন মা কিংবা একজন বাবাকে, তাহলে? মুহূর্তেই উত্তরটা দিয়ে দেবেন তারা। কারণ সব মা-বাবার কাছে যে নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় তার সন্তান!
এই অমূল্য সম্পদ যদি হারিয়ে যায়? এই হারানোর কষ্ট শুধু তারাই বোঝেন যারা এটি হারিয়েছেন। দুই বছর চার মাস বয়সী একমাত্র শিশুকন্যা রাফিদা খান রাইফাকে হারিয়ে প্রতি মুহূর্তে সেই কষ্টের সাগর পার করছেন সাংবাদিক রুবেল খান ও তাঁর স্ত্রী রুমানা খানম।
গত বছরের ২৯ জুন মধ্যরাতে নগরের ম্যাক্স হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শিশু রাইফা। পরিবারের অভিযোগ, ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ভুলের শিকার রাইফা।
আজ ১৬ জুন (রোববার) বিশ্ব বাবা দিবস। প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানকে ছাড়াই বিশেষ এই দিনটি কাটাতে হচ্ছে রুবেল খান দম্পতিকে। অথচ গতবছরও বাবা দিবসে রাইফা মনিকে নিয়ে আনন্দে মেতেছিল পুরো পরিবার। এক বছরের ব্যবধানেই সেই আনন্দ পরিণত হয়েছে বিষাদে।
সন্তান হারানোর পর প্রতিটি দিনই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অসহায় পরিবারটিকে। আর বিশেষ দিনগুলোতে সেই কষ্ট যেন বেড়ে যায় বহুগুণে।
বাবা দিবসে সাংবাদিক রুবেল খানের বাসায় গেলে দেখা যায় তিনি মুঠোফোনে গান শুনছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের বিখ্যাত সেই গান- ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/আয় খুকু আয়/আয় খুকু আয়…’।
গান চললেও রুবেল খান যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্য জগতে। বাবা দিবসের প্রসঙ্গ তুলতেই শুরুটা করলেন একেবারে গোড়া থেকে- সামান্য গলা ব্যাথা নিয়ে গতবছরের ২৮ জুন ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম আমার মা’কে (মেয়েকে)।কিন্তু ওই হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই রাইফাকে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসায় প্রচণ্ড অবহেলাও ছিল। আমি নিষেধ করার পরও চিকিৎসকরা আমার মেয়েকে রফিসিন নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করেন। আমার আপত্তির মুখে চিকিৎসকরা বলেন, এই অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করা হলে আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং ওর গলা ব্যাথা দ্রুত ভালো হয়ে যাবে। অথচ ওই অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করার পর আমার মেয়ের শরীরের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যেতে থাকে।
পরে অন্য হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওভারডোজ অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করায় আমার মেয়ের রিঅ্যাকশন হয়েছিল। ওই রিঅ্যাকশনের কারণে তার শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনি হয়। খিঁচুনির কারণে আমার মেয়ের যখন মুমূর্ষু অবস্থা, তখন আবারও ভুল চিকিৎসার শিকার হয় সে। তাকে আইসিইউতে না নিয়ে কেবিনের ভেতর ওভারডোজ সেডিল পুশ করা হয়। এভাবে বারবার অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করে আমার একমাত্র শিশুকন্যা রাইফা।
এ মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত কমিটি ম্যাক্স হাসপাতালের ১১টি ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা যদি সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন দুটির সহায়তা নেন তাহলে মামলার তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করা সহজ হবে।
সাংবাদিক রুবেল খান আরও বলেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তন, অবহেলা-ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু প্রতিরোধ এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের স্বার্থে রাইফা হত্যার বিচার চাই। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট প্রদানের দাবি জানান শোকাহত এই বাবা।
রুবেল খান অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বাঁচাতে চট্টগ্রামের বিএমএ নেতাদের একটি অংশ ও ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ক্ষমতা ও টাকার জোরে সবকিছু নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন সাংবাদিক রুবেল খান।
এর আগে গতবছরের ১৮ জুলাই ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসায় অবহেলায় মেয়ের মৃত্যুর অভিযোগ এনে চার চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় এজাহার দায়ের করেন রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল খান। দু’দিন পর এজাহারটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মামলায় ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত, ডা. শুভ্র দেব ও ম্যাক্স হাসাপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খানকে আসামি করা হয়। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছেন চকবাজার থানার ওসি (তদন্ত) রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী।
বাবা দিবস এসেছে, বাবা দিবস চলেও যাবে। আবার হয়ত আসবে অন্য কোনো দিবস। আবার হয়ত রুবেল খান আনমনাভাবে শুনবে সেই গান- ‘আয় খুকু আয়’।
রুবেল খানের ‘খুকু’ আর কোনোদিন আসবে না। বাবার বুক জড়িয়ে ধরে করবে না কোনো বায়না। এই সত্যটা আমরা সবাই জানি। তবে একজন বাবার জন্য এই সত্যটা মেনে নেওয়া কষ্টের, ভীষণ কষ্টের।
রুবেল খান তাঁর খুকুকে আর ফিরে পাবেন না। এরপরও অসম প্রতিপক্ষের সঙ্গে তিনি আইনি লড়াই করছেন। না, খুকুকে ফিরে পাওয়ার জন্য নয়; আর কোনো খুকুকে যাতে এভাবে চলে যেতে না হয় সেজন্য!
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, জয়নিউজ