সম্প্রতি জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। তিনি ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের কথা বললেন। বাস্তবে জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। অন্য খাতের বরাদ্দকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অন্তভুর্ক্ত রেখে এবারো টাকার অংক বেশি দেখানো হয়েছে। এ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে শিক্ষায় বরাদ্দের নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষায় বরাদ্দের নামে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোট বাজেটের পরিমাণ বড় হওয়ার কারণে শিক্ষায় বরাদ্দের পরিমাণটাও বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না বরাদ্দের আনুপাতিক হার। টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়ানো দাবি করে সরকার। গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদদের বিশ্লেষণে শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্থ বরাদ্দে দেখা যায়, ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন বাবদ এ বছর মোট বরাদ্দ ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৬.৭৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০৪ শতাংশ। খাত ওয়ারি এবং বিভাগ ও মন্ত্রণালয় ওয়ারী বরাদ্দের মধ্যে পর্যালোচনা করলে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থের সঙ্গে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় না। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে এক করে মোট বাজেটের ১৫.১৯ শতাংশ বরাদ্দ করে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। প্রযুক্তি খাতকে বাদ দিলে শুধু শিক্ষা খাতের বরাদ্দ দাড়ায় ১১.৬৮%।
অন্যান্য বছরের ন্যায় বিভিন্ন খাতকে শিক্ষায় যুক্ত করে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা এবারও লক্ষণীয়। শিক্ষায় বরাদ্দে শিক্ষাবিদ আমিরুল আলম খানের মন্তব্য- চালাকিটা পুরানো। শিক্ষাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না দেবার চালাকি। ফৌজি হুকুমতে শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতো খেলাধুলা, যাতে বরাদ্দের অংকটা বড় দেখায় আর প্রচার করা যায় হুকুমত জ্ঞানচর্চায় বহুত আগ্রহী। এবারও তার অন্যথা হলো না।
সরকার ইউনেস্কো ও ডাকার সম্মেলনে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ ও ৬ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ২০ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ১০ থেকে ১২ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোনো কোনো অর্থবছরে এর চেয়ে সামান্য বেশি বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেটা কখনোই ২০ শতাংশে পৌঁছেনি। টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়ানোর দাবি করে প্রতিটি সরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার বরাদ্দ নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ঠদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। শিক্ষা খাতে পৃথক বাজেট এখন সময়ের দাবি।
দেশের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগের বেশি ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক। সকলের প্রত্যাশা তাদের জন্য পৃথক বাজেট প্রণয়ন। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ওয়ারী বরাদ্দে দেখা যায় বৈসাদৃশ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের পরিমাণ ২৯ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। মোট বাজেটের শতকরা হারে এই খাতে এর পরিমাণ ৫.৬৬ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪ হাজার ৪১ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৪.৬০ শতাংশ। এই দুই মন্ত্রণালয় মিলিয়ে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা এবং মোট বরাদ্দের ১০.২৬ শতাংশ। আবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দ ২৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দ ৭ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। সেই হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৭.১০ শতাংশ। এর সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা যুক্ত করলে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১.৬৮ শতাংশ ও জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১১.৫৯ শতাংশ। বর্তমান বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ আগের বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে শতাংশের হিসেবে বেড়েছে মাত্র ০.০৯ শতাংশ। জিডিপি হিসেবে বেড়েছে ০.০১ শতাংশ। গত বারের তুলনায় শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৮ হাজার ৯৭৩ কোটি বেড়েছে।
চলতি অর্থ বছরে (২০১৮-১৯) শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ৫২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে যা মোট বাজেটের ১২.৫৯ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বাজেটে কেবল শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৪৯ হাজার ১০ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১৪.৩৮ শতাংশ।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। মোট বাজেটের ১০.৭১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১.৫৮ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১১.২৮ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১.১৭ শতাংশ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১২.১১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে একটি দেশের শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দে তা আদর্শ ধরা হয়।
চট্টগ্রামের শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দর খানের মতে, আমাদের প্রতিবেশি সবদেশে শিক্ষাখাতে ৪ শতাংশের উর্ধ্বে বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সে তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। প্রতিবারই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর কথা আমরা শুনি। কিন্তু এই বাড়ানোর পরিমাণটা গতানুগতিক বলেই আমি মনে করি। এটি গতিপথ ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষার গুণগত তেমন পরিবর্তন আশা করা যায় না।
তিনি বলেন, আমরা যেসব দেশের সমকক্ষ হওয়ার আশা করি, সেসব দেশ ছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের তুলনায় দুর্বল অনেক দেশও শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রকৌশলী ও কারিগনি খাতেও আশানুরূপ বরাদ্দ হয়নি।
ভবিষ্যতে আমরা যেখানে যেতে চাই সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে এই বরাদ্দ যথেষ্ঠ নয় বলে অভিমত মু. সিকান্দর খানের।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোও (ব্যানবেইস) বলছে, বাংলাদেশ শিক্ষাখাতে জিডিপির যে অংশ ব্যয় করছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। শিক্ষাখাতে বরাদ্দকে ব্যয় হিসেবে গণ্য না করে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা জরুরি।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বাজেটে শিক্ষায় ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের ৯ বছর পরও তা বাস্তবায়িত হয়নি। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, এমনকি আফগানিস্তানেও শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকে। বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
সত্যিকারের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা চাই, আর উন্নয়নকে টেকসই করতে চাই গুনগত শিক্ষা। বিশ্বে যারা বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্র, তারা সর্বপ্রথম শিক্ষায় উন্নতি করেছে।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মতে, প্রতিবছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তা জাতীয় বাজেট বরাদ্দের কত শতাংশ বাড়ছে সেটা দেখা দরকার। সবসময় শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কিন্তু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত মোট বাজেটের ২০ শতাংশ। দক্ষ ও উৎপাদনশীল জনবল বাড়াতে শিক্ষার বিকল্প নেই। শুধু বরাদ্দ দেখলেই হবে না। সেটা কোনদিকে যাচ্ছে সেটাও দেখতে হবে। শিক্ষাখাতে দুর্নীতি হয় সবচেয়ে বেশি। দুর্নীতি দূর করতে নজরদারিত্ব বাড়াতে হবে। শিক্ষাখাতে দুর্নীতি রোধ করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি ও যথাযথ ব্যবহার দুই’ই নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের একাংশ রাখা হয়েছে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তিতে। দীর্ঘ ৯ বছর বন্ধ থাকা এমপিওভুক্ত কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। জুলাই থেকে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে ১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এমপিও বিহিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজপথের আন্দোলনে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাসের বাস্তবায়নে এ বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়া হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়। নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের লড়াইয়ের বিজয়ে সূর্যের আলোর দেখা মিলেছে।
বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারী যারা দেশের অধিকাংশ, আগামী প্রজম্মকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত তাদের প্রতি উদাসীনতার মনোভাব এ বাজেটেও পরিলক্ষিত হয়েছে। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে বাজেটে কোনোপ্রকার উল্লেখ না থাকায় সকলের মনে চরম দুঃখ ও ব্যাথা।
বিগত বছরে পাঁচ লক্ষাধিক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও বৈশাখী ভাতা প্রদান করার কথা উল্লেখ করা হলেও শিক্ষার বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় করণের ব্যাপারে অর্থ বরাদ্দ এ বাজেটেও উপেক্ষিত। দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ‘শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করনই’ একমাত্র পথ। ‘শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করন’ আজ শিক্ষকদের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। সরকারি সব সেক্টরে সুযোগ সুবিধা ও প্রমোশন প্রথা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শুধু ব্যতিক্রম পাঁচ লক্ষাধিক বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেলায়। যেন বাংলার চালু প্রবাদ প্রবচন ‘তালেব মাস্টারদের প্রমোশন নেই, ডিমোশনও নেই। শুধু শিক্ষার্থীদের প্রমোশন হয়। এখন দেখি তালেব মাস্টারদের প্রমোশন নেই, ডিমোশন আছে।’
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দিয়ে আবার প্রতি মাসে ৪ শতাংশ কেটে রাখা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মানসম্মত শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে জাপানের সম্রাট মেইজির উদাহরণ টেনে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষক এনে দেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন। উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি মেটাতে এ উদ্যোগ বলা হলেও দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমুহে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে নিয়োজিত শিক্ষক সমাজ এ ঘোষণা সহজভাবে মানতে পারছেন না। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বিশাল অংশ বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যে বেতন-ভাতা এতে মেধাবীরা কেন এ পেশায় আকৃষ্ট হবে? শিক্ষা নিয়ে যদি সত্যিকার অর্থে চিন্তা করা হয়, বিদ্যমান সংকট উন্নয়নে যদি আন্তরিকতা থাকে, তাহলে প্রথম কথা হচ্ছে এ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে। অযোগ্যতা যদি থেকেও থাকে সেক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগে কর্মকমিশন ও ফলপ্রসু প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে গত ১৪ জুন ২০১৯ জাতীয় পত্রিকাসমুহে শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় বাস্তব তথ্য। মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, ভালো লেখাপড়ার জন্য তিনটি বিষয় দরকার। সেগুলো হচ্ছে ভালো পাঠ্যবই, ভালো পরীক্ষা পদ্ধতি এবং ভালো শিক্ষক। ভালো পাঠ্যবই আর ভালো পরীক্ষা পদ্ধতি হয়তো সহজেই পাওয়া যাবে, তবে ভালো শিক্ষক কিন্তু এত সহজ নয়। এর জন্য আমাদের টাকা খরচ করতে হবে। আমি সবসময় কল্পনা করি শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা বেতন স্কেল হবে এবং সেই স্কেলটি হবে খুব আকর্ষণীয় একটা স্কেল। সেটি এমন আকর্ষণীয় হবে এবং তার সঙ্গে স্কুল শিক্ষকদের এত রকম সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক সম্মান দেওয়া হবে যে, একজন তরুণ শিক্ষার্থী পাস করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য এবারের বাজেটে শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ কথা সত্য, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় এবং ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, উপবৃত্তির টাকা বৃদ্ধিতে আর যাইহোক শিক্ষার মান কখনো বাড়বে না। শিক্ষকদের জন্য এমন ব্যবস্থা কী করা যায় না, যা হলে তাদের অন্যচিন্তা না করে পেশার প্রতি মনোযোগী হবেন। তাছাড়া ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বাজেটে আজো দৃশ্যমান বরাদ্দ নেই। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে যথোপযুক্ত বরাদ্দ না থাকায় এতে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সুন্দর পরিবেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদানে বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ যুগের দাবি। যেকোন কিছু বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকতে হবে। এর বাস্তব উদাহরণ পদ্মা সেতু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতিহারে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দের অঙ্গীকার ছিল। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থায় কোথায় কোন খাতে কতটুকু অপচয় হচ্ছে তা নিরূপণ ও চিহ্নিত করা দরকার। শিক্ষাখাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হবে। তাছাড়া বরাদ্দের পরিকল্পিত ব্যয়ও নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক কালের কন্ঠের গত ১০ মে ২০১৯-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের মতো অবস্থানে থাকাকালে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিত শিক্ষায়। এর সুফল এখন তারা পাচ্ছে। এক সময় ওই সবদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে এলেও এখন এ দেশের শিক্ষার্থীরা ওইসব দেশে পড়তে যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে এগিয়ে। সে দেশে একসময় জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হতো শিক্ষায়। এখন শিক্ষা ব্যবস্থা একটা পর্যায়ে পৌঁছায় তা জিডিপির ২.২৮ শতাংশে নেমেছে। তবে শিক্ষার পেছনে অন্য মন্ত্রণলয়গুলোর ব্যয় ধরলে তা জিডিপির ২.৫ শতাংশ দাঁড়ায়। আর শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত চলে রাষ্ট্রীয় খরচেই।
বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিত পূর্বক শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষাখাতে জটিলতা সৃষ্টি করছে। সর্বোপরী শিক্ষাখাতে ব্যয় একটা লাভজনক বিনিয়োগের সমতুল্য। এখানে ক্ষতি বা লোকসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানে ব্যয়ের পরিমাণ যতই বাড়বে রাষ্ট্রের ততই উন্নতি হবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে চাই দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ।
লেখক:
প্রধান শিক্ষক, ড. শহীদুল্লাহ একাডেমী, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম অঞ্চল।