আবদুচ ছালাম। স্বঘোষিত ‘কর্মবীর’ পরিচয়ে নিজের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন গত দশ বছর ধরে। এ নিয়ে কম কথা হয়নি তাঁর নিজ দল আওয়ামী লীগেও।
নিজের প্রচারণার জন্য দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাঁকে শোকজ করেছিল নগর আওয়ামী লীগ। এমনকি রাজনীতির অতিথিখ্যাত ছালামকে বহিষ্কারের দাবিও উঠেছিল তখন।
সেসময় প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, আবদুচ ছালাম দলের কোষাধ্যক্ষ হলেও দলের কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না। উল্টো সিডিএ’র সুযোগ-সুবিধা ও দলের পদ ব্যবহার করে থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে মতবিনিময় সভা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন।
শুধু প্রচার-প্রচারণা নয়, আরো অনেক বিষয়ে নিজের অবস্থান নিয়ে সমালোচিত হন ১/১১ এর সেনা সমর্থিত সরকারের কাছে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে সম্মানিত আবদুচ ছালাম।
আরও পড়ুন: ছালামের কারণেই চসিককে হস্তান্তর করা হয়নি ফ্লাইওভার!
একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। ২০১২ সালে ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ২৩ জন। আর পঙ্গুত্ববরণ করেন আরো অনেকে। ওই সময় ফ্লাইওভারের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিভিন্ন মহল। এক ধরনের চাপের মুখে সেই সময় ফ্লাইওভারের কাজ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন ছালাম।
২০১২ সালের সেই ঘটনার দাগ এখনও তাড়া করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে। এরমধ্যেই এবার ওয়াকওয়ে ধসের ঘটনা ঘটেছে নগরের পতেঙ্গায়।
২০১৯ সালের ১৩ জুলাই। শহর রক্ষায় নির্মিতব্য ‘উপকূলীয় বাঁধ কাম আউটার রিং রোড’র পতেঙ্গা চরপাড়ায় সাগরের পাশ ঘেঁষা হাঁটার রাস্তার (ওয়াকওয়ে) কিছু অংশ ধসে পড়েছে। উদ্বোধনের আগেই এ ধরনের ঘটনায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এলাকাবাসীর মাঝে। কাজের মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের মতো এখানেও যদি হতাহতের ঘটনা ঘটত তবে এর দায় নিত কে?
স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, এখনো ওয়াকওয়ে তৈরির কাজ শেষ হয়নি। এরমধ্যেই সেটি দেবে গেছে। চাপ বেশি পড়ে বলে এটি রড দিয়ে আরসিসি ঢালাই করার দরকার ছিল। কিন্তু ওয়াকওয়েটিতে তা করা হয়নি।
আরও পড়ুন: ছালাম আর বাণিজ্যিক বিলবোর্ডে একাকার ফ্লাইওভার!
ঘটনাটি জানার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা ঝড় উঠেছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের যোগ্যতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণই নয়, নগর পরিকল্পনাবিদরাও মনে করছেন এই নির্মাণকাজে বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মান্নান ফেরদৌস জয়নিউজকে বলেন, বিগত দিনে ছালাম সাহেব দল এবং দলীয় প্রধানের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছেন। চট্টগ্রাম শহরে দলীয়ভাবে যদি বিবেচনা করা হয়, আবদুচ ছালামের চেয়ে অনেক যোগ্য লোক সিডিএ’র চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওনাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আবদুচ ছালাম তাঁর কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ওনার মেয়াদকালীন সময় পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দায়িত্ব থেকে সরে এসে নিজের প্রচার-প্রচারণাতেই তিনি বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, আবদুচ ছালাম চট্টগ্রামের ৭০ লাখ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এখন সময় এসেছে প্রধানমন্ত্রীর টাকার হিসেব নেওয়ার। এখনো উদ্বোধন হয়নি। কিন্তু পতেঙ্গায় ওয়াকওয়ে ধসে যাচ্ছে। এর ফলে সরকারের বদনাম হচ্ছে।
চিন্ময় দত্ত নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই (ছালাম) কিছু অসাধু লোকের বদন্যতায় বদনাম হয় পুরো দলের, সরকারের অতিসত্বর দুদক এর দ্বারা সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মহোদয় এর মেয়াদকালের যাবতীয় সকল কার্যক্রম তদন্ত করে দেখা দরকার। আবার যেন বহাদ্দারহাট ফ্লাইওভার ট্রাজেডি না হয়…’
মোহাম্মদ আজিম নামে এক প্রবাসী লিখেছেন, ‘পতেঙ্গা আউটার রিং রোড সি-বীচের গার্ডার কোথাও ছিটেফোঁটা লোহার অস্তিত্ব নেই। ঢালাই ৬ মাস হবার আগেই ভেঙে গেল…হায়রে হায়রে হরিলুট।’
রহমত উল্লাহ রিফাত লিখেছেন, ‘কর্মবীরের কর্ম বলে চাটগাঁ শহর ভাঙা’র তলে। কি দরকার ছিলো লোক দেখানো সাময়িক সুনাম অর্জনের। পতেঙ্গা আউটার রিং রোড সি-বীচের গার্ডার লোহা ছাড়া ঢালাই ৬ মাস হবার আগেই ভেঙে গেল। ধন্যবাদ বিগত দিনের সিডিএ চেয়ারম্যান সাহেব।’
এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার জয়নিউজকে বলেন, সাগরের পাশে কাজ করার সময় মাটি সরে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়। সেটি বিবেচনায় না রেখে এ ধরনের কাজ করা মানে অর্থ অপচয়। সাধারণত এ ধরনের কাজগুলো পাইলিংয়ের ওপর হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত ভরবহন করার প্রয়োজন হলে সেখানে প্রি-কাস্ট কংক্রিট পাইল ব্যবহার করা হয়। এর কিছুই এখানে করা হয়নি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জয়নিউজকে বলেন, সাগরে পানি বেড়ে যাওয়ায় ঢেউয়ের কারণে ব্লক সরে বিশাল অংশ দেবে গেছে। কাজটা সম্পূর্ণ না হওয়াতে অনেক জায়গায় ব্লক বসানো হয়নি। ফলে সেটি ধসে পড়েছে।
তবে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছেন ভিন্ন চিত্র। বাঁধের ব্লক সরে মাটি তলিয়ে যাওয়ায় সিসি ঢালাইয়ে তৈরি ওয়াকওয়েটি ধসে পড়েছে। এ অবস্থায় ওই অংশ চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। হঠাৎ ওয়াকওয়েটির বিশাল অংশ ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ২০০৫ সাল থেকে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধ কাম আউটার রিং রোড নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। যাচাই শেষে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে জাইকা।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে চার লেনের এ সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
উপকূলীয় বাঁধ কাম আউটার রিং রোড নির্মাণ নামের এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ১৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ। এর মধ্যে ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার মূল ও ২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এ ছাড়া আছে প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে।
শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮৬৫ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। দুই বার সংশোধনের পর বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১ হাজার ৭২০ কোটি ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও জাইকার সহায়তা ৭০৬ কোটি টাকা।
ইতোমধ্যে প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছর এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
জয়নিউজ/এমজেএইচ