চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) কর্তৃক অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার, আবাসন নির্মাণ এবং পুকুর-জলাশয় ভরাটের কারণে ডুবছে চট্টগ্রাম নগর। দিন দিন জলাবদ্ধতা বাড়ছে, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অপরিকল্পিত এ নগর উন্নয়নের জন্য দায়ী চউক’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তিনি গত ২৩ এপ্রিল অবসরে যান। জলাবদ্ধতা বিষয়ে গত বছর তিনি বলেছিলেন, ‘মাফ চাই, এবার নয়, কিন্তু আগামী বছর বিশাল সফলতা দেখবেন।’ কিন্তু চলতি বছরও কোনো সফলতা দেখা গেল না। বরং আগের চেয়ে বেশি জলাবদ্ধ হয়েছে নগর।
চকবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. নাজিম উদ্দীন জয়নিউজকে বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও জলাবদ্ধতায় কষ্টে আছি। কিছুদিন আগে বাড়ির পাশে চাক্তাই খাল পরিষ্কার হওয়ায় ভেবেছি, এ বছর বর্ষায় অন্তত পানি কম উঠবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে আগের চেয়ে বেশি পানি উঠেছে।
তিনি আরো বলেন, চউক এর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম নগরকে অপরিকল্পিত নগরে পরিণত করে গেছেন। নিজের ইচ্ছামতো যেখানে সেখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছেন। পুকুর-জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরি করেছেন। যার ফলে এই বর্ষায় পুরো নগর জলমগ্ন হয়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জলাধারের জায়গায় ভবন নির্মাণ কিংবা আবাসিক এলাকা গড়ার অনুমোদন দিয়েছে চউক। কোথাও আবার নিজেরাই গড়ে তুলেছে আবাসিক এলাকা। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার মানুষ বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় ভুগছে। হালিশহর হাউজিং এস্টেটের অবস্থাও একই। অক্সিজেন মোড় এলাকায় বৃষ্টি হলেই পানি জমছে। সেই পানি নামছে না কয়েকদিনেও। বালুচরা থেকে অনন্যা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ থাকছে পানিবন্দি।
এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ভারি বর্ষণে শুধু নগরের নিচু এলাকা নয়, প্রধান প্রধান সড়ক, ফ্লাইওভার, অলিগলি, বাসাবাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে জনজীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। জলাবদ্ধতায় নগরবাসী সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এখন।
নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, অক্সিজেন-কুয়াইশ সংযোগ রোড এলাকার উভয়পাশে পাঁচলাইশ ও হাটহাজারী মৌজায় গড়ে তোলা অনন্যা আবাসিক এলাকাটি ছিল চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকার পানির রিজার্ভার। হালদা নদী থেকে মাটি এনে ভরাট করে অনন্যা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে চউক। এখন পানির আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। কল্পলোক আবাসিক এলাকাও একসময় ছিল পানির রিজার্ভার। বাকলিয়া এলাকার পানি এখানে আটকানো হতো। কিন্তু কল্পলোক প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় নামে দুটি আবাসন এলাকা গড়ে তোলার পর থেকে বাকলিয়া এলাকার মানুষ পানিবন্দি থাকছে। কল্পলোক ছাড়াও বাকলিয়ার বগারবিল ছিল আরেকটি পানির রিজার্ভার। সেখানেও ব্যক্তি উদ্যোগে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। ভবনগুলোর অনুমোদন দিয়েছে চউক।
এ বিষয়ে চউক বোর্ড সদস্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান জয়নিউজকে বলেন, এই নগরকে ধ্বংস করেছে চউক। কারণ নগরের কোথায় কি হবে এর পরিকল্পনার দায়িত্ব চউক’র হাতে। তারা প্রাকৃতিক ওয়াটার রিজার্ভারগুলো নিজেরা আবাসিক এলাকা তৈরি করে মানুষের মধ্যে বরাদ্দ দিয়েছে। আবার ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ভবনের অনুমোদনও দিয়েছে।
তারা বলেন, শুধু অনন্যা কিংবা কল্পলোক আবাসিক এলাকা নয়। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকাও গড়ে উঠেছে নিচু এলাকায়। মাটি ভরাট করে এই আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হলেও, এখন জলে ডুবে আছে এলাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনন্যা, কল্পলোক, বগারবিল ছাড়াও নগরের রামপুরা ওয়ার্ডের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একসময় প্রাকৃতিক জলাধার ছিল। সেখানে দেওয়ান হাট, ঈদগাহ, মনছুরাবাদ, শান্তিবাগ, হালিশহর প্রভৃতি এলাকার পানি ধারণ করা হতো। কিন্তু সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। ফলে হালিশহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ এখন পানিবন্দি।
জানা যায়, বিবিরহাট সুন্নিয়া মাদ্রাসা, ফরিদের পাড়া, শমসের পাড়া, আশেকানে আউলিয়া কলেজ ও হাজীপাড়ার মধ্যবর্তী বিশাল এলাকায় বর্ষাকালে পানি জমে। কিন্তু সেখানেও ভবন উঠছে। কয়েক বছর পর এই জলাধারটিও হয়তো হারিয়ে যাবে।
আমরা শুধু আমাদের বাসস্থানের চিন্তা করি। কিন্তু পানির চলাচল কিংবা পানি ধারণের কোনো পরিকল্পনা করি না, বললেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী এম. আলী আশরাফ। তিনি জয়নিউজকে বলেন, আমরা আমাদের পুকুর ও দিঘিগুলো ভরাট করে ফেলেছি। এগুলো একসময় পানি ধারণ করতো। একইসঙ্গে নালা ও খালগুলো ভরাট কিংবা সংকোচন করেছি। এতে পানি চলাচলের কোনো সুযোগ থাকছে না। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে চউক’র ব্যর্থতা ছিল স্বীকার করে এর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, চউক’র অনন্যা আবাসিক এলাকাটি কৃষিজমি ছিল এবং বর্ষায় তা জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হত। একইভাবে কল্পলোক কিংবা আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার কথাও বলা যায়। বিগত ১০ বছরে চউক ব্যস্ত ছিল শুধু ফ্লাইওভার তৈরির কাছে। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাই না করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো দৃশ্যমান উন্নয়নের নামে যত্রতত্র ফ্লাইওভার তৈরি করা হলেও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে প্রতিটি ফ্লাইওভারের নিচে মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই হাঁটু থেকে কোমর পানি জমছে।
তিনি বলেন, পরিদর্শন না করে যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদান ও নালা-খালের দেওয়াল ঘেঁষে ভবন নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতা বেড়েছে বহুগুণ। অপরদিকে জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য চউককে দেওয়া ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, এখনো পুরোদমে কাজ শুরু হয়নি।
এছাড়া নগরের সেবা সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয় না থাকায় সরকারের অর্থ অপচয় ছাড়াও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী, যোগ করেন তিনি।
জয়নিউজ/আরসি