জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত এ সংগঠনটি। জঙ্গি গোষ্ঠীর মতো নিজ দলের প্রতি আনুগত্য এবং যেকোনো সিদ্ধান্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শিবিরের নেতাকর্মীরা। এমনই একজন বায়েজিদ সুমন।
২০১৩ ও ২০১৪ সালে শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন বায়েজিদ। গর্ববোধ করতেন নিজেকে শিবিরকর্মী পরিচয় দিতে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো সময়ের ব্যবধানে সেই একনিষ্ঠ শিবিরকর্মী বনে গেছেন ‘প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী’!
নগরে ‘নগরফুল’নামে একটি সংগঠন রয়েছে বায়েজিদের। এ সংগঠনটির বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে নগরজুড়ে। অভিযোগ রয়েছে, নগরফুলের আড়ালে শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে বায়েজিদ।
২০১৩ সালে নিজের ফেইসবুক একাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বায়েজিদ। আরেক ব্যক্তির মন্তব্যের বিপরীতে তিনি লিখেছিলেন- ‘যা শিবির করি, কিছু করতে পারবি, দূরে যাই মর’!
জয়নিউজের পক্ষ থেকে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় বায়েজিদ সুমনকে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বলেন, ‘আবেগের বশে হয়ত ২০১১ বা ২০১২ সালের আগে ভালো লাগা কাজ করত। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের কথাতো দূরে থাক, ব্যক্তিগত চিন্তাও করিনি। কোনো দলের সঙ্গে ছিলামও না, লেখালেখিও করিনি। তবে বিএনপিকে ভালো লাগত। কিন্তু এখন তাদেরও ঘৃণা করি। আজে-বাজে বক্তব্য দেয় তাদের নেতারা।’
২০১১-১২’র পর ২০১৩ সালে ফেইসবুক পোস্টের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এর কোনো ব্যাখা দেননি। শুধু বলেন, ‘আমার মামা বিএনপি নেতা, আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। বড় ভাই শিবির করতেন, তাই বলে আমি শিবির করব এমন চিন্তা করা যায় না।’
নিজের বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করলেও ওই পোস্টে বায়েজিদ লিখেছিলেন, ‘আমি কাউকে শুভেচ্ছা জানাব না, কারণ আমরা সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারিনি। বেঁচে থাক বাবা, জীবনে কখনো আওয়ামী লীগ করবি না। এদের কারণে মানুষ আমাদের কুত্তার বাচ্চা বলে।’
নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দাবি করা এই বায়েজিদই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবিতে বিভিন্ন স্ট্যাটাস ও পোস্ট শেয়ার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে শেয়ার করা একটি পোস্ট ছিল এমন- ‘সাঈদীসহ অন্য জামায়াত নেতাদের মুক্তি না দিলে বাংলাদেশ একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হবে’।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিবিরকর্মী বায়েজিদ দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াত-বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নগরের একে খান মোড়ে চলা সংঘর্ষে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জয়নিউজের অনুসন্ধানে।
এদিকে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বরের আরেকটি স্ট্যাটাসে বায়েজিদ লিখেছিলেন, ‘হে মুমিন ভাইরা নারায়ে তাকবির বলে এগিয়ে চলো সম্মুখপানে। বিজয় আমাদের সন্নিকটে’।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সময় নিজেকে শিবিরকর্মী হিসেবে জাহির করতে গর্ববোধ করতেন বায়েজিদ। পরবর্তীতে তিনি মহানগর ছাত্রশিবিরের সিদ্ধান্তে অবস্থান টিকিয়ে রাখতে কয়েকজন শিবিরকর্মীসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে কাজ করা শুরু করেন। গড়ে তুলেন পথশিশুদের নিয়ে সংগঠন ‘নগরফুল’। স্পর্শকাতর এ বিষয়টিকে পুঁজি করে তারা শহরজুড়ে খুব দ্রুত গড়ে তুলেন নিজস্ব বলয়। যার সঙ্গে জড়িত হয়েছেন দেড় হাজারেরও বেশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। যাদের বেশিরভাগই জানেন না কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে নগরফুল। আর এ সংগঠনেরই সভাপতি বায়েজিদ সুমন।
এ নিয়ে তৎকালীন মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজম রনি নিজের ফেইসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। যে পোস্টে একটি ছবিতে মার্ক করে দিয়েছিলেন নগরফুলের প্রতিষ্ঠাতা কয়েকজন শিবির কর্মীর নাম ও পদবি।
এ পোস্টটির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বায়েজিদ সুমন বলেন, উনার পোস্ট দেখেছি। ওই পোস্টে উনি আমার কথা বলেননি। আমাদের সংগঠনের অন্যদের কথা বলেছেন। আমরা পরবর্তীতে ওদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বাদ দিয়েছি। দুই-একজন শিবির ছিল এর বেশি না।
কারা শিবির ছিলেন জানতে চাইলে তিনি শুধু একজনের নাম বলেন। সাইফুল ইসলাম শিবির করতেন, তাকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করেছি।
বায়েজিদ বহিষ্কারের কথা বললেও জয়নিউজের অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিবিরকর্মী সাইফুল এখনো নগরফুলের এক্টিভ নেতা। প্রত্যেক কার্যক্রম এবং আয়োজনে উপস্থিত থাকেন তিনি।
বহিষ্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল জয়নিউজকে বলেন, আমাকে কেন বহিষ্কার করা হবে। বহিষ্কার বা এ ধরনের কোনো কিছুই হয়নি। আমি এখনো নগরফুলের প্রায় প্রোগ্রামে থাকি। সভাপতি (বায়েজিদ) যদি বলে থাকে কেন বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করেন।
শিবিরের সঙ্গে যোগসূত্র আছে কি-না জানতে চাইলে নগরফুলের সাবেক সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম অকপটে স্বীকার করেন শিবির করার কথা। তিনি বলেন, ‘আমিতো এখন ছাত্র নই, তাই ছাত্রশিবির করি না। তবে ছাত্র থাকাকালীন ছাত্রশিবির করেছি। এখন অন্যকিছু করি।’
অন্যকিছু কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা বলার মতো সময় এখন নয়।’
বহিষ্কার করা হয়েছে- এমন মিথ্যা তথ্য কেন দিয়েছেন জিজ্ঞেস করা হলে বায়েজিদ জয়নিউজকে বলেন, ‘সাইফুল আমাকে ফোন করেছে, তাকে আপনি কি আমার নাম বলেছেন? তিনি এখন আমাকে দোষারোপ করছেন। তাকে বহিষ্কার বলতে গ্রুপ থেকে রিমুভ করা হয়েছিল।’
শিবিরের কোনো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অসম্ভব! আমি মুক্তধ্বনি, লিও ক্লাব, রেড ক্রিসেন্টে কাজ করতাম। এরপর ২০১৫-তে এসে নগরফুল।’
জয়নিউজের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে, শিবিরের সংগঠন পারাবার সাংস্কৃতিক সংগঠনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন বায়েজিদ। যে সংগঠনের সঙ্গে ছিল শিবিরের সংগঠন সাইমুম শিল্পগোষ্ঠী ও পাঞ্জেরী শিল্পগোষ্ঠীর সরাসরি যোগসূত্র। এসব বিষয় তুলে ধরা হলে বায়েজিদ বলেন, পারাবারে আমি কাজ করতাম সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে, তাই বলিনি। এই সংগঠন শিবির কি-না তা আমি জানতাম না।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি জয়নিউজকে জানান, বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার আসামি ও জামায়াত নেতা চৌধুরী মাইনুদ্দীনের সংগঠন মুসলিম এইডের অর্থায়নে তাদের প্রথম দিকের প্রোগ্রাম হয়। যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামি ও জামায়াতের অর্থায়নের তাদের কাজ সন্দেহজনক ছিল। তারউপর তাদের সঙ্গে যারা ছিল সবাই এক্টিভ শিবির কর্মী। তাই আমি ওই স্ট্যাটাসটা তখন দিয়েছিলাম। এখনো আমার বক্তব্য একই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি গোলাম রসুল নিশান জয়নিউজকে বলেন, ‘ছেলেটা (বায়েজিদ) আমার এলাকায় থাকে। আমি পুরো আকবরশাহ থানায় ছাত্রলীগের একটা গ্রুপ মেনটেইন করি। তাকে কখনো ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে দেখিনি। তবে কোটা আন্দোলন ও বিভিন্ন কার্যক্রমে সে সরকারবিরোধী ভূমিকায় ছিল বলে জানতে পেরেছি। আর এখন প্রমাণগুলো দেখে স্পষ্ট, সে শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসীন জয়নিউজকে বলেন, সিআরবিসহ শহরের বিভিন্ন স্পটে পথশিশুদের নিয়ে সামাজিক কাজ করে নগরফুল- এটুকুই জানি। তবে তাদের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগসূত্র আছে কি-না জানা নেই।
তবে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম জয়নিউজকে বলেন, আপনাদের হাতে থাকা প্রমাণগুলো আমাদের দিন। আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখব। যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ, নগরফুলের বায়েজিদ সুমন চট্টগ্রামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত মুখ। নগরফুলসহ বিভিন্ন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। এর সুযোগে আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে বসেন তিনি! সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে পাচ্ছেন বেশ অনুদানও।