চট্টগ্রাম নগরের পাড়ায়-পাড়ায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ। দিনদুপুরে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অন্য গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ, টাকার বিনিময়ে জমি জবর-দখল, ইভটিজিং, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ প্রায় সব ধরনের অপরাধেই সিদ্ধহস্ত তারা। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। পুলিশ ও র্যাব বলছে, এসব গ্রুপের সদস্যদের চিহ্নিত করা ও তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে তারা।
সম্প্রতি বরগুনায় রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী নামে দুই যুবক। নয়ন ও রিফাত ফরাজী দুইজনই ফেসবুকভিত্তিক ‘০০৭’নামে একটি গ্রুপের সদস্য ছিল। মূলত ওই গ্রুপেই রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। গোয়েন্দা তথ্য মতে, এ ধরনের গ্রুপের আদলেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী দল।
নগরের বড় বড় সব অপকর্মের হোতা এসব গ্রুপের সদস্যরা। নানা সময় তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য পরিচয় দেন। তবে দলীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি নেই তাদের। এদের অনেকে আবার বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও পরিচয় দেন। আবার কখনো এদের দেখা মেলে নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কিংবা স্থানীয় পর্যায়ের নেতার অনুষ্ঠান-সমাবেশে। যদিও অপরাধ সংঘটিত হলে এদের চিনতেও রাজি হন না তারা!
এসব গ্রুপের সদস্যরা নগরে জমি-ফ্ল্যাট কেনা-বেচা, সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও বড় অংকের চাঁদা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় দলে দলে উদ্ভট শব্দে মোটরবাইক দাপিয়ে বেড়ায় তারা। কথায় কথায় নানা স্থানে তৈরি করে হাঙ্গামা-হট্টগোল।
জয়নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরের চান্দগাঁও এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য রাজু গ্রুপের। এ গ্রুপের প্রধান মো. রাজুর নামেই গ্রুপের নাম। সে বহদ্দারহাটের কসাইপাড়ার বাসিন্দা। এ গ্রুপের সদস্যরা বহদ্দার পুকুর পাড় এলাকার প্রত্যেকটি দোকান থেকে চাঁদাবাজি করে। সন্ধ্যায় তারা চাঁদা সংগ্রহ করতে বের হয়। এছাড়াও এ গ্রুপের সদস্যরা ছিনতাই ও মাদক বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। ছয় মাস আগে বাড়ইপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রাজু গ্রুপের সঙ্গে প্রতিপক্ষ গ্রুপের মারামারির ঘটনা ঘটে। কিছুদিন আগে মাদক ব্যবসার বিষয়ে রাজুকে খুঁজতে তার বাসায় যায় গোয়েন্দা পুলিশ। রাজু এলাকায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার কোনো পদ নেই। তার নামে চাঁদাবাজি ও মাদক মামলা রয়েছে বলে চান্দগাঁও থানা সূত্রে জানা যায়।
নগরের কাজীর দেউরি কাঁচাবাজার এলাকা থেকে আলমাস সিনেমা হল পর্যন্ত ছিনতাই ও মাদক ব্যবসায় জড়িত ‘কুল এন্ড ডুড’গ্রুপের সদস্যরা। এ গ্রুপের প্রধান রায়হান ও গিয়াস। তাদের গ্রুপে আছে আরো ১৫ জন সদস্য। অন্যদিকে তাহসীন গ্রুপের সদস্যরা লালখানবাজার, হাইলেভেল রোড ও মতিঝর্না এলাকায় ইভটিজিং, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ গ্রুপের প্রধান আলী আরমান তাহসীনের নামেই গ্রুপের নামকরণ। তার নামে খুলশী থানায় ধর্ষণ ও অপহরণ মামলা আছে।
নগরের বেটারিগলি ও দামপাড়া এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য তুষার গ্রুপের। এক বছর আগে দামপাড়ায় বাবার সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যার শিকার অনিক হত্যা মামলার প্রধান আসামি মহিউদ্দিন তুষার এ গ্রুপের প্রধান। এ গ্রুপে আরো আছে মিন্টু, ইমরান শাওন, জোনায়েদ আহম্মদ ইমন, জোবায়েদ আহম্মদ শোভন, রকি, অপরাজিত, অভি, বাচা, এখলাছুর রহমান এখলাছ, দুর্জয় ও অজয়। এরা সবাই অনিক হত্যা মামলার আসামি। হত্যার পর এদের কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও এখন সবাই জামিনে মুক্ত। জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারো তারা মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও ইভটিজিংয়ে জড়িয়ে পড়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়েই তুষার গ্রুপের হাতে খুন হয়েছিল অনিক।
নন্দন কানন এলাকায় রতন গ্রুপের কাছে জিম্মি সাধারণ মানুষ। এ গ্রুপের প্রধান রতন ও রাকিব। তারা কারাগারে অপর এক কয়েদির হাতে নিহত অমিত মুহুরীর অনুসারী বলে জানা যায়। অমিত মুহুরী মারা যাওয়ার পর এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে রতন ও রাকিব। তাদের সঙ্গে আরো আছে এমরান ও জুনাইদ। এছাড়া আরো ১০ জনের মতো কিশোর তাদের গ্রুপে আছে। নন্দন কানন এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও ইভটিজিংয়ে জড়িত তারা। কোতোয়ালি থানায় রতন ও রাকিবের নামে ছিনতাই ও মাদক মামলা আছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (সদর) শ্যামল কুমার নাথ জয়নিউজকে বলেন, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তথ্য আমাদের কাছে আছে। এসব গ্রুপের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলাও রয়েছে। শিগগির এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাব-৭ এর মিডিয়া অফিসার ও সহকারী পুলিশ সুপার মো. মাশকুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, নগরের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায় জড়িত গ্রুপগুলোর তথ্য সংগ্রহ করছি আমরা। অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে র্যা ব।