খাগড়াছড়ির রামগড়ে দেশের ২৩তম স্থলবন্দরের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এর অংশ হিসেবে ফেনী নদীর ওপর (রামগড়-সাবরুম অংশে) নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলবে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর। তৈরি হবে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই স্থলবন্দরকে ঘিরে স্থানীয়দের প্রত্যাশা অনেক।
গত ১৬ জুন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ ও রামগড় স্থলবন্দরের নির্মাণকাজের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনকালে রিভা গাঙ্গুলী দাশ সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য সম্প্রসারণে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ স্থলবন্দর চালু হলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুনাচল- এই সাত রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। অর্থনৈতিকভাবে হবে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ স্থলবন্দরের কাজ দীর্ঘদিন থমকে ছিল। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় কাজে গতি এসেছে। চলতি বছরেই দৃশ্যমান হবে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দরের অবকাঠামো। এজন্য ভারত সরকার ফেনী নদীর উপর চার লেনের আন্তর্জাতিকমানের একটি সেতু নির্মাণকাজ হাতে নিয়েছে।
রামগড় পৌরসভার মহামুনি ও সাবরুমের আনন্দপাড়া এলাকা হয়ে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এজন্য ভারত সরকারের খরচ হবে ১১০ কোটি রুপি। নির্মাণ সময়সীমা ধরা হয়েছে দুই বছর পাঁচ মাস। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার ইতিমধ্যে স্থলবন্দরকে ঘিরে বন্দর টার্মিনাল, গুদামঘরসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করেছে।
এ বিষয়ে কথা হয় খাগড়াছড়ির বিশিষ্টজনদের সঙ্গে। ব্যবসায়ী সুদর্শন দত্ত ও অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী জয়নিউজকে বলেন, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক খবর। একটা সময় ধরেই নিয়েছিলাম এটি বোধহয় আর হচ্ছে না। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহ এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতায় আলোর মুখ দেখছে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো স্থাপিত এই স্থলবন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞ পাহাড়ের দরিদ্র মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে তাঁরা আশা প্রকাশ করেন।
এর আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০১৮ সালে রামগড় সফরকালে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রামগড় স্থলবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের ৩৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক (রামগড়-বারৈয়ারহাট পর্যন্ত) উন্নয়ন কাজ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ও জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকার তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হবে।
চার লেনের এ সড়কের জন্য খরচ হবে তিন হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনার বিষয়টি সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। অন্যদিকে ত্রিপুরার আগরতলা থেকে সাবরুম পর্যন্ত রেললাইনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সাবরুম রেলস্টেশনে অবকাঠামোগত বেশকিছু নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সাবরুম-উদয়পুর-আগরতলা সড়কের উন্নয়নকাজ চলছে।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মংপ্রু চৌধুরী ও রামগড় বাজারের ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর রহমান মতি ভাষ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই সচেষ্ট ছিল। সেতুটি নির্মিত হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো (সেভেন সিস্টার্স) চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরা।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজুরী চৌধুরী জয়নিউজকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথমবারের রেল যোগাযোগ চালু হবে রামগড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত উভয় পক্ষ উদ্যোগী হওয়ায় স্থলবন্দর বাস্তবায়নের কাজে গতি এসেছে। যে কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সবাই আশার আলো দেখছেন।
সবমিলিয়ে রামগড় স্থলবন্দর পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া রামগড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সূচিত হবে নতুন দিগন্ত। আঞ্চলিক গন্ডি ছাপিয়ে তাই এ স্থলবন্দর আন্তর্দেশীয় সেতুবন্ধনের এক নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে।
জানা যায়, খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা রামগড় স্থলবন্দরের অগ্রগতি নিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। সরেজমিন পরিদর্শনও করেছেন অনেকে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ২৩তম স্থলবন্দর হচ্ছে খাগড়াছড়ির রামগড়ে। এজন্য রামগড়ের মহামুনিতে ১০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের সংযোগ সেতুটির নির্মাণ করবে ভারত সরকার। তবে মূল সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ১৫০ মিটার। ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ স্থলবন্দরের কাজ সম্পন্ন হবে।
উল্লেখ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রামগড়ে স্থলবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই স্থলপথ ও অভ্যন্তরীণ জলপথে ভারত ও মায়ানমার থেকে আমদানি-রপ্তানি বা খাদ্য ছাড়করণের উদ্দেশে দেশে ১৭৬টি শুল্ক স্টেশনের তালিকা ঘোষণা করে।
ওই তালিকায় ৪৮ নম্বরে ছিল রামগড়। পরে সরকার ঘোষিত স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বেশকিছু চালু হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় রামগড় স্থলবন্দরের কাজ দীর্ঘদিন ফাইলচাপা থাকলেও ২০১০ সালে কাজে পুনরায় গতি আসে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় রামগড়ে স্থলবন্দর স্থাপনের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। ২০১৫ সালের ৬ জুন ঢাকা সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেনী নদীর উপর রামগড়-সাবরুম মৈত্রী সেতু-১ এর ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করেন।