সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেদখল হয়ে গেছে রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিপুল পরিমাণ জমি। শুধু চট্টগ্রাম বিভাগেই অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে রেলওয়ের ২১৫ একর জমি, কর্মকর্তাদের হিসাবে যার মূল্য আনুমানিক ৩ হাজার কোটি টাকা!
গত ১০ বছরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিশেষ করে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে ব্যাপকহারে রেলের জমি দখল করা হয়েছে। প্রভাবশালী দখলদাররা এসব জমিতে কোথাও বহুতল মার্কেট, কোথাও বাজার, আবার কোথাও বসতঘর বানিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন।
বছরের পর বছর চলে গেলেও কয়েক হাজার কোটি টাকার এসব জমি উদ্ধার করতে পারছে না রেলওয়ে। মাঝে মধ্যে দখলদার উচ্ছেদে অভিযান চালানো হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সে জমি আবার দখলদারদের কবজায় চলে যাচ্ছে। কোথাও জাল দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে আবাসন কোম্পানির ভবন তোলা হয়েছে। রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেও জমি দখলের অভিযোগ আছে। ফলে হাইস্পিড ট্রেন চালুসহ রেলওয়েকে ঘিরে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রেল সূত্র জানায়, রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগে মোট জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৭০১ একর। এরমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে ২১৫ একর জমি। সংশ্লিষ্টদের মতে, বেদখল সম্পত্তির মূল্য কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে ৮৭ দশমিক ৫ একর। ১২৭ দশমিক ৫ একর দখল করেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের রেলস্টেশন সংলগ্ন আইস ফ্যাক্টরি রোড, কদমতলী, পাহাড়তলী, টাইগারপাস, খুলশী, আমবাগান, আকবর শাহ, ফয়’স লেকসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলওয়ের মূল্যবান জমি দখলে নিয়ে বহুতল ভবন, মার্কেট ও বসতবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। রেলের জমিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস। দখল থেকে রক্ষা পায়নি রেললাইনের আশপাশের খালি জায়গা, পাহাড়, টিলাও।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ ও দলটির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নামেও রেলের অনেক জমি দখল করা হয়েছে। এসব জমি অবৈধ দখলমুক্ত করতে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফের বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
তবে রেলের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেও জমি দখলের অভিযোগ আছে। বিশেষ করে রেলের শ্রমিক নেতাদের কারণে অনেক জায়গাই দখলমুক্ত করা যায় না। অবৈধ দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন কর্মকর্তারা।
স্থানীয়রা জানান, দখলের পাশাপাশি রেললাইনের দুই ধারে মাদকের আখড়া গড়ে তুলেছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট।
এদিকে উচ্ছেদ করা রেলের জমি পুনর্দখলও থেমে নেই। এর আগে রেলস্টেশন সংলগ্ন নগরে মাদকের সবচেয়ে বড় স্পটখ্যাত বরিশাল কলোনি থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়। এসময় মাদক সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে পরিচিত ফারুক র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। ২০১৮ সালের শেষদিকে রেলওয়ে থেকে ওই জায়গাটির ২ দশমিক ০৩ একর লিজ নেন কয়েকজন ব্যক্তি। তারা সেখানে গড়ে তোলেন শাহ আমানত রেলওয়ে সুপার মার্কেট। তবে রেলের হিসাবমতে সেখানে মোট জায়গা আছে ৩ দশমিক ৭১ একর। পুরো জায়গাজুড়েই মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ১ দশমিক ৬৮ একর জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়েছে মার্কেট নির্মাণকারীরা। ধারণা করা হচ্ছে, রেলের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এ ঘটনার নেপথ্যে জড়িত আছেন।
রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা ইশরাত রেজা জয়নিউজকে বলেন, রেলের বিপুল পরিমাণ জমি বেদখল হয়ে গেছে। বেদখল ভূ-সম্পত্তি রক্ষায় সীমিত লোকবল নিয়েও রেলওয়ে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলের দুই বিভাগে বেদখলে আছে ৫৪২ একর জমি। এ পর্যন্ত ৪১৯ একর জমি দখলমুক্ত করা হয়েছে। আগামী দিনেও উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিশেষ কোনো অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়নি।
উল্লেখ, রেলওয়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী অবৈধ দখলমুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করে রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ। এরপর ওই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকে প্রকৌশল বিভাগ। ভূ-সম্পত্তি পাহারার দায়িত্বে থাকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি। জানা যায়, এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে একদিকে অবৈধ দখল বাড়ে অন্যদিকে উচ্ছেদকৃত জমিও পুনরায় দখল হয়ে যায়।