সময় তখন রাত ৯টা। রাউজানের আবুল হাসান জটিল কিডনি রোগ নিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১৭নং ওয়ার্ডে। বেড না মিললেও ওয়ার্ডের মেঝেতে নিজের জন্য জায়গা খুঁজে নেন তিনি।
তবে ব্যথায় কাতর আবুল হাসানকে সেবা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেকটা সময়। কারণ রাতে প্রায় ৬০ জন রোগীর ওয়ার্ড সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন একজন মাত্র ডাক্তার। সেই ডাক্তারও ব্যস্ত ছিলেন আগে থেকে ভর্তি হওয়া মুমূর্ষু এক রোগীকে নিয়ে!
প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে চমেক হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে। যদিও সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক, ইন্টার্ন ডাক্তাররা রোগী দেখে থাকেন। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে ডাক্তারদের সংখ্যা। বিশেষ করে রাতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দেখা মেলে না বললেই চলে। যে কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের পড়তে হয় বিপাকে।
জানা যায়, চমেক হাসপাতালে মোট শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৩১৩টি। কিন্তু ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের মানুষের প্রধান এই চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রে প্রায় সময়ই আড়াই হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এই বিশাল সংখ্যক রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল।
তাই রাতে চিকিৎসক সংকটে রোগীদের ছুটে যেতে হয় উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার ও হাসপাতালের নার্সদের কাছে। তারা জানান, নতুন রোগী ভর্তি হলে তারাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। রোগীদের অবস্থার অবনতি হলে তারা চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেটা সম্ভব না হলে তারা নিজেরাই ওষুধপত্র দেন!
তবে শুধু রাতেই নয়, সরকারি ছুটির দিনে, বিশেষ করে শুক্র ও শনিবারে হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই ওয়ার্ডগুলোতে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না আসায় নিজেদের ভোগান্তির কথা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
দুপুর-সন্ধ্যা-রাতে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন আহমেদ জয়নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলে জনবল সংকট একটা বড় সমস্যা। তারপরও এখানে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকেন। তাই চট্টগ্রামে কয়েকটি আলাদা আলাদা বিশেষায়িত হাসপাতাল দরকার।
তিনি বলেন, এখানে যারা আছেন তারা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। তারা কেন রাতে ডিউটি করবেন? তারা সকালে ক্লাস নেন। পাশাপাশি হাসপাতালে এসে রোগীও দেখেন।
তিনি আরো বলেন, রাতে ডাক্তার থাকেন না ব্যাপারটা তেমন না। তবে সংখ্যায় কম এটা ঠিক। যারা থাকেন তাদের মধ্যে রোস্টার পদ্ধতিতে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। ডাক্তাররা তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করেন।
বিষয়টির সমাধান অনেক গভীরে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ডাক্তার নিয়োগ দেওয়ার সময়ই ঠিক করতে হবে কে কখন ডিউটি করবে। মন্ত্রণালয় থেকেই প্রজ্ঞাপন হয়ে আসতে হবে ব্যাপারটা।
চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হাসপাতালের ৩৩ নম্বর প্রসূতি ও গাইনী ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডকে পাঁচটি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে। একটি ইউনিটে ২০ জন করে রোগী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এরপরও রোগী বেশি হয়ে গেলে মেঝেতে তাদের সিট দেওয়া হয়। অন্য ওয়ার্ড থেকে এ ওয়ার্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন বেশি। কিন্তু শুক্রবার এ ওয়ার্ডেও থাকেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অথচ এ ওয়ার্ডে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০টি ডেলিভারি হয়। তারমধ্যে গড়ে ২২টি সিজার অপারেশনের মাধ্যমে। বন্ধের দিন বাদ দিয়ে এসব অপারেশন করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
আনোয়ারা থেকে আসা মো. হামিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি জয়নিউজকে বলেন, সন্ধ্যার পর আমার বড় ভাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে আসি। ভর্তির প্রায় দুই ঘণ্টা পর একজন ডাক্তার দেখতে আসেন।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ছুটির দিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও অন্যান্য চিকিৎসকরা থাকেন। তারা চিকিৎসা দেন নিয়মিত। রোগীদের তাই কোনো সমস্যা হয় না।