ইঞ্জিন সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিঘ্নিত হচ্ছে রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) যাত্রীসেবা। বর্তমানে রেল পূর্বাঞ্চলে যাত্রীবাহী রেলের জন্য প্রয়োজন ১৫২টি ইঞ্জিন। কিন্তু রেলের বহরে যুক্ত আছে মাত্র ১০৫টি। অর্থাৎ, চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ ইঞ্জিন ঘাটতি থাকে প্রতিদিন।
পণ্যবাহী রেলের অবস্থাও একই। বর্তমানে পণ্য পরিবহনে দুই হাজার সিরিজের ইঞ্জিন ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে যুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তান আমল শেষ, নতুন বাংলাদেশ হয়ে এর বয়স হতে চলল ৪৮ বছর। কিন্তু এখনও সেই পুরোনো মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই চলছে পণ্য পরিবহন।
রেলওয়ে নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহে উদ্যোগ নিলেও সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সহসা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এদিকে রেলে যেসব ইঞ্জিন রয়েছে ভালো নয় সেগুলোর অবস্থাও। চলার পথে যখন-তখন বন্ধ হয়ে পড়ছে। বাড়ানো যাচ্ছে না গতি। ঠিক রাখা যাচ্ছে না রেলের শিডিউলও। ফলে যেসব ট্রেনে এসব ইঞ্জিন যুক্ত করা হয়, বিড়ম্বনার শেষ থাকে না সেগুলোর যাত্রীদের।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রথম বড় ধরনের ইঞ্জিন সংকট তৈরি হয় ২০০২ সালের দিকে। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে কোরিয়া থেকে ২০টি এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে ১৯টি ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। সংকট কিছুটা কমে তখন। তবে কয়েক বছর ধরে আবার তা বেড়েছে। ইঞ্জিন সংকটের কারণে ট্রেনের অনেক আন্তঃনগর, মেইল এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসব ট্রেনের গড় সময়ানুবর্তিতার হার ছিল ৯২ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ৯১ শতাংশে নেমে আসে। আর ২০১৯ সালে সেটি ৮৯ শতাংশতে গিয়ে ঠেকেছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট রশিদা গনি সুলতানা জয়নিউজকে বলেন, রেলে এখন ইঞ্জিন সংকট খুব বেশি। জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহে মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ের ইঞ্জিন সংকটের কথা স্বীকার করেছেন খোদ রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ পরিদর্শনে এসে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত কোচ থাকলেও রেলের শিডিউল রক্ষায় ইঞ্জিন সংকট সবচেয়ে বড় বাধা। চলমান ট্রেনগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের সাহায্যে চালাতে গিয়ে ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। তবে ইঞ্জিন সংকট কাটাতে ভারত থেকে ২০টি ইঞ্জিন ভাড়ায় আনার বিষয়টি বিবেচনা করছে রেলওয়ে।
রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত একটি ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা থাকে ২০ বছর। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে যে ছয়টি ২০০০ সিরিজের ইঞ্জিন আছে সেগুলোর ইকোনমিক লাইফ পার হয়ে গেছে চার দশকেরও বেশি সময় আগে। নতুন ইঞ্জিন না থাকায় মেরামতের মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়েই সচল রাখা হচ্ছে ইঞ্জিনগুলো। বলা যায় একপ্রকার জোর করেই কাজ চালানো হচ্ছে।
এ ছাড়া বহরে থাকা অন্য ইঞ্জিনগুলো ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা। কিন্তু এগুলোর গতি ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারের বেশি বাড়ানো যায় না। গতি বাড়াতে গেলেই বন্ধ হয়ে পড়ছে, নতুবা ঘটছে দুর্ঘটনা।
সূত্র জানায়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে তেলবাহী ট্যাংকের জন্য দুটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চাহিদা ছিল ২১টি ট্রিপ। প্রতি ট্রিপের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু ইঞ্জিন সংকটের কারণে তেল দিতে না পারায় মাসে রেলের আয় কমেছে ৯৪ লাখ ৫০ হাজার।
এছাড়া সিলেট, শ্রীমঙ্গল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, রংপুরসহ কিছু কিছু জায়গায় তেল সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও সিলেটে ১৬টি ট্রিপের চাহিদার বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে ১০ ট্রিপ। যেখানে প্রতি ট্রিপ তেল সরবরাহের জন্য ৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা রেলওয়ে আয় করলেও ইঞ্জিন সংকটের কারণে বাকি ৬ ট্রিপ দিতে না পারায় প্রতি মাসে আয় কমেছে ২৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮০০ টাকা।
এছাড়া বন্দর থেকে সরকারি গম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়। কিন্তু ইঞ্জিন সংকটের কারণে পাঁচ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে চার হাজার টন।
রেলের মেকানিক্যাল ও পরিবহন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চার হাজার কোটিরও বেশি টাকায় রেলের জন্য ১৪০টি ইঞ্জিন সংগ্রহের কার্যক্রম চলছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে ইঞ্জিনগুলো পর্যায়ক্রমে রেলের বহরে যুক্ত হবে। প্রথম দফায় ১০টি ইঞ্জিন আসবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। হুন্দাই কোম্পানি ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করবে।
আরেকটি চুক্তির আওতায় ৭০টি ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। এর বাইরে ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। এরপর ২০টি মিটারগেজ ইঞ্জিনও কেনা হচ্ছে।
ইঞ্জিন সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সৈয়দ ফারুক আহমদ জয়নিউজকে বলেন, ইঞ্জিন সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য ইতোমধ্যে সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে। ইঞ্জিন কেনার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি তহবিলে এতো টাকা নেই। এডিবি এরইমধ্যে এগিয়ে এসেছে। ৭০টি ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। এগুলো যুক্ত হলে এ সংকট আর থাকবে না।