‘চাকরিসহ স্টুডেন্ট ভিসা। ইউএসএ, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, স্কটল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড। পড়াশোনায় গ্যাপ গ্রহণযোগ্য- চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় রশি দিয়ে টানানো এমন অনেক বিজ্ঞাপন দেখা যায়। শুধু চকবাজার নয়, এ ধরনের অসংখ্য বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে চট্টগ্রামের অলিগলি-রাজপথে।
এসব চটকদার বিজ্ঞাপনের টার্গেট যুবসমাজ। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করাই তাদের বাহ্যিক উদ্দেশ্য। আসলে উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশে পাঠানোর আড়ালে ‘আদম ব্যবসায়’ নেমেছে কিছু প্রতিষ্ঠান। তাদের পাল্লায় পড়ে অনেকে খুইয়েছেন সর্বস্ব। লাখ লাখ টাকা জমা দিয়ে বিদেশে যেতে পারেননি। গেলেও তাদের অনেকেই এখন ঘুরছেন বিদেশের রাস্তায় রাস্তায়।
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে ছাত্র ভর্তির নামে একরকম মহানৈরাজ্য চলছে। এ নিয়ে রীতিমতো ফাঁদ পেতে বসেছে একশ্রেণির প্রতারক চক্র। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন শহরে এই প্রতারকচক্র ছড়িয়ে আছে। বিদেশের নামি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স বা মাস্টার্সে ভর্তির নামে প্রতিবছর এসব প্রতারকচক্রের সদস্যরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে শত শত প্রতিষ্ঠান অনেকটা নির্বিঘ্নেই এ কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ দেখার কেউ নেই।
বিদেশি ডিগ্রি আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে অনেকেই ভিটেবাড়ি, মায়ের অলংকার, হালের বলদ থেকে শুরু করে মূল্যবান সম্পত্তি বিক্রি করে প্রতারকচক্রের হাতে টাকা তুলে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই ভাগ্যে জোটে প্রতারণা। বিদেশে যাওয়া তো দূরের কথা, জমা দেওয়া অর্থও ফেরত পায় না তারা। শেষ পর্যন্ত মামলাসহ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অনেকে হয়রানির শিকার হন।
শুভাশিষ শুভ নামের একজন ভুক্তভোগী অস্ট্রেলিয়া থেকে জয়নিউজকে জানান, তাকে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ডে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বলে সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু গিয়ে দেখেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে অন্য এক প্রতিষ্ঠানে তাকে পাঠানো হয়েছে। সবমিলিয়ে তিন কক্ষের একটি ক্যাম্পাস নিয়েই চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানা যায়, উচ্চশিক্ষার নামে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। সিটি করপোরেশন থেকে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তারা এই প্রতারণামূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বিজ্ঞাপনগুলোতে উন্নত দেশে পাঠানোর কথা উল্লেখ থাকায় শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুবকেরা পড়াশোনার আড়ালে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রতারকদের কাছে ধর্ণা দিয়ে থাকেন। কিছু প্রতিষ্ঠান এসএসসি পাস শিক্ষার্থীদেরও বিদেশে পাঠানো হবে বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কোনো নীতিমালা নেই, সরকারি নিয়ন্ত্রণও নেই।
এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদেশি যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশি, সেগুলোতে পাঠালে প্রতিশ্রুতিমতো সবকিছু মেলে না।
তিনি জানান, সিটি করপোরেশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে সারা দেশে অন্তত ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর কাজ করছে। লাইসেন্সবিহীন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে আরও অন্তত পাঁচ হাজার।
সূত্র জানায়, এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা নির্দিষ্ট একটি দেশকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সে অনুযায়ী এই বলে প্রচার শুরু করে যে, নির্দিষ্ট ওই দেশে চাকরি ও পড়াশোনা- দুটোই সহজে চালানো যায়। সে অনুযায়ী পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়া, দেয়াললিখন ও সাইনবোর্ডের মাধ্যমে একযোগে প্রচার-প্রচারণার কাজ চলে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্যবস্তু যুক্তরাজ্য ও কানাডা। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর আলোচনায় ছিল সাইপ্রাস। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেন, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়ামের মতো দেশও পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে বহুল আলোচিত লোভনীয় নাম হয়ে উঠেছে।
‘অ্যামবিশন প্লাস কনসালট্যান্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা প্রায় অর্ধশত ছাত্র সর্বস্ব খুইয়ে এখন প্রতারকদের খুঁজছেন। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর নামে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ করে টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা পালিয়ে যায়। চট্টগ্রাম, রাজধানীর ধানমন্ডি ও সিলেটে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় ছিল।
ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আগ্রহী ব্যক্তিরা তথ্য জানতে এলে তাদের নানাভাবে চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়। তিন মাসের মধ্যে বিদেশে পাঠানো হবে- এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নেওয়ার পর তাদের ঘোরানো শুরু হয়। একপর্যায়ে বলা হয়, যে কলেজে ভর্তির জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে, সেই কলেজের সঙ্গে তাদের সমস্যা চলছে। অন্য কলেজে ভর্তির জন্য চেষ্টা চলছে। এভাবে একপর্যায়ে তারা গা ঢাকা দেয়।
এদিকে, র্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে ওই চক্রের হাতে প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী প্রতারিত হয়েছে। তবে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
র্যাব জানায়, এসব প্রতিষ্ঠান শুধু একটি ব্যবসায়িক লাইসেন্স (ট্রেড) নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে, না বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফলে ওই সব প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, মানুষ ঠকানোর এ ব্যবসা লাগামহীন ও অবাধে আর কতদিন চলতে থাকবে।
জানতে চাইলে র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পরিচালক এএসপি মো. মাশকুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অনিয়মের তথ্য আমাদের কাছে আছে। শিগগিরই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।