নগরের উত্তর পতেঙ্গার ধুমপাড়া এলাকার ক্লাব ‘নবারুণ সংঘ’। সরকারি জমি দখল করেই ভুঁইফোড় এই ক্লাবটি গড়ে তুলেছেন জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, দশমিক ৬৫ একর সরকারি জমি দখল করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল ও দোকানপাট। সরকারি জায়গায় জমিদারি করেই জামায়াত-বিএনপির একেকজন নেতা প্রতি মাসে আয় করছেন লাখ টাকা!
এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, নবারুণ সংঘ নামের ক্লাবের আড়ালে এখানে নিয়মিত গোপন বৈঠক করে জামায়াত-শিবির।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও মামলার নথি থেকে জানা যায়, নবারুণ সংঘ নামের ক্লাবটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। কিন্তু উচ্চ আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্যি চলছে ক্লাবটি। মূলত জামায়াত-বিএনপির নেতাদের কারণেই ক্লাবটি চালু রয়েছে। নিজেদের শক্তির জানান দিতে নিয়মিত ক্লাবে বৈঠকও করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত নবারুণ সংঘের বর্তমান সভাপতি মো. হারুন। যিনি জামায়াত ছেড়ে বর্তমানে পতেঙ্গা থানার ৪০নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে আছেন। সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন পতেঙ্গা থানা জামায়াতের সাবেক অর্থ সম্পাদক মো. আলী আকবর। আর উপদেষ্টা হিসেবে আছেন পতেঙ্গা থানা জামায়াতের আমির মো. জানে আলম।
সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, পতেঙ্গা ধুমপাড়ার কাটগড় ও ফুলছড়িপাড়া রোডে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দশমিক ৬৫ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে নবারুণ সংঘ, পতেঙ্গা রেঁনেসা কিন্ডারগার্টেন স্কুলসহ দুটি সামাজিক ক্লাব। ওই জায়গার গলির ভেতরে রয়েছে একটি তিনতলা ভবন। এছাড়া রাস্তার পাশে দীর্ঘ সারিতে রয়েছে দোকানপাট, সেমিপাকা, কাঁচা ঘরসহ শতাধিক স্থাপনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশাল এই জায়গার এক-তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছেন ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হারুন। তিনি ২০০৪ সাল থেকে ওই জায়গায় পতেঙ্গা রেঁনেসা কিন্ডারগার্টেন কেজি স্কুলসহ ২০-২৫টি দোকানপাট ও স্থাপনা নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিয়েছেন। প্রতিটি দোকান থেকে মাসিক ভাড়া আদায় করা হয় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, দখল করা ওই জায়গায় পুকুরের মধ্যে একটি একতলা ভবনের নির্মাণকাজও ইতোমধ্যে শেষ করেছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই জায়গার কিছু অংশ দখলে নিয়েছেন আরেক ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ। তাঁর দখলে রয়েছে ধুমপাড়া এলাকার পূর্ব গলি থেকে জামালের পানির ট্যাংক পর্যন্ত অংশ। যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৩০-৪০টি টিনশেড দোকান ও ভাড়া ঘর। এসব স্থাপনা থেকে প্রতি মাসে লাখ টাকা ভাড়া আদায় করেন ইমতিয়াজ।
অন্যদিকে ধুমপাড়ার মূল সড়ক থেকে ওই জায়গার কিছু অংশ দখলে নিয়ে স্থাপনা করেছেন আরেক বিএনপি নেতা সাজ্জাদ হোসেন। তিনিও ২০-২৫টি দোকান নির্মাণ করে ভাড়ায় লাগিয়েছেন। তাঁর আয়ও মাসে লাখ টাকা।
জানা যায়, ১০ বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই জায়গায় একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়। সাইনবোর্ডে লেখা হয়- ‘তফসিলভুক্ত দশমিক ৬৫ একরের জায়গার মালিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তফসিলভুক্ত ভূমিতে কোনোপ্রকার অনুপ্রবেশ, নির্মাণ, সংস্কার, পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তবে জেলা প্রশাসনের লাগানো এই সাইনবোর্ড কৌশলে ঢেকে ফেলা হয়েছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও স্থাপনায়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সাবেক বন্দর বর্তমানে উত্তর পতেঙ্গা মৌজা তফশীলভুক্ত দশমিক ৬৫ একরের জায়গার মালিক দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। যার বিএস খতিয়ান নম্বর ৬, আরএস দাগ নম্বর ১০০৩১ এবং বিএস দাগ নম্বর ৭৬৮৬। ওই জায়গাটিতে অধিদপ্তরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অর্থায়নে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়্যারহাউজ স্থাপন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জায়গার একাধিক ভাড়াটিয়া জানান, ২০০৪ সাল থেকে তারা সেখানে ব্যবসা করছেন। ওই সময় অর্ধলাখ টাকা সালামি দিয়ে ১৫ বর্গফুটের একেকটি দোকান বরাদ্দ নেন। পাঁচ বছর পরপর ভাড়ার চুক্তির মেয়াদ বাড়ান দখলদাররা। বর্তমানে তিন ব্যক্তির দখলে থাকা জায়গায় পৃথকভাবে দোকান ও ঘর ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি দোকানে বর্তমানে সালামি হিসেবে নেওয়া হচ্ছে লাখ টাকা।
দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে পতেঙ্গা থানা ৪০নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. হারুন জয়নিউজকে বলেন, জায়গা খালি পড়ে ছিল তাই আমরা স্কুল ও ক্লাব করেছি। কিন্তু দোকান কারা করেছে জানি না। সরকার যদি বলে তাহলে এখনই জায়গা ছেড়ে দেব।
নবারুণ সংঘে জামায়াত-শিবিরের গোপন বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করেন। এমনকি তিনি নিজেকে ওয়ার্ড বিএনপির নেতা নন বলেও দাবি করেন। তবে তাঁর ফেসবুক আইডিতে ঢুকে দেখা যায়, গত ঈদুল আজহাতেও তিনি ৪০নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হিসেবে ওয়ার্ডবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
নবারুণ সংঘে জামায়াত-শিবিরের গোপন বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া জয়নিউজকে বলেন, আমিও এলাকাবাসীর কাছ থেকে শুনেছি এখানে গোপনে বৈঠক হয়। তবে কেউ এখানো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর বারেক কোম্পানি জয়নিউজকে বলেন, হারুন আগে জামায়াত করত। এখন সে বিএনপির লেবাস লাগিয়েছে। নবারুণ সংঘে এখনো জামায়াত-শিবিরের মিটিং হয়। আর এটি সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি একটি জায়গার উপর কীভাবে জামায়াত-শিবির ক্লাব চালাতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এছাড়া ক্লাবের পাশে যে কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে সেটিতেও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি নেওয়া হয়। প্রশাসনের উচিত অচিরেই ক্লাবসহ সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্থানীয় কাউন্সিলর হাজী জয়নাল আবেদীন জয়নিউজকে বলেন, তারা যেভাবে জায়গা দখল করে দোকানপাট ও স্কুল বানিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে হয়। সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিয়ে আমি ওই স্থানে একটি বয়েজ কলেজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হারুন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বাধার মুখে করতে পারিনি। কারণ কলেজ হলে তারা সেখানে গোপন বৈঠকও করতে পারবে না, প্রতি মাসে লাখ টাকাও কামাতে পারবে না। প্রশাসনকে অনেকবার আমি বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু অজানা কারণে প্রশাসন নীরব।
বিষয়টির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসনের পতেঙ্গা জোনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তৌহিদুল ইসলাম জয়নিউজকে বলেন, পতেঙ্গা এলাকার জায়গাটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের। এ জায়গা দখলের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।