চট্টগ্রামে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) দুটি শাখা থেকে উধাও হয়ে গেছে গ্রাহকের ১৩ কোটি টাকা! নগরের ও আর নিজাম রোড এবং চান্দগাঁও শাখা থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া এ টাকার জন্য একে একে ১০টি মামলা করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭ জনকে। এর মধ্যে দুইজন ব্যাংকের কর্মকর্তা হলেও বাকি ৫ জন ব্যাংকটির সাধারণ গ্রাহক!
এদিকে ইবিএল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার। কারণ টাকা আত্মসাতের মামলা দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) এখতিয়ার হলেও তারা মামলা করেছে থানায়। আবার বিষয়টি জেনেও মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ।
পুলিশ মামলাগুলো নিয়ে আদালতে গেলেই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। আদালত আদেশ দেন- পুলিশ নয়, মামলাগুলো তদন্ত করবে দুদক। সব মামলা দুদকে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে অভিযুক্ত দুই ব্যাংক কর্মকর্তা বলছেন, ভয় দেখিয়ে জোর করে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মামলায় আসামি হওয়া ব্যাংকটির এক গ্রাহকদের সোজা কথা, আমিতো ব্যাংকের কেউ নই, আমি কীভাবে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় যুক্ত থাকব?
যা ঘটেছে
দুদক সূত্র জানায়, ইবিএল ঢাকার গুলশান শাখার তিন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আজিম উল্লাহ, শাহেদ বিন মান্নান ও অনন্ত কুমার খাঁ বাদী হয়ে গত ৮ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানায় আটটি এবং চকবাজার থানায় দুটি মামলা করেন।
একটি মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ইবিএল চান্দগাঁও শাখার গ্রাহক কনা দে। তাঁর হিসাবে জমা হওয়া সাড়ে ১৩ লাখ টাকার এফডিআর খুলতে ২০১৬ সালের জুনে অনুরোধ করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. ইফতেখারুল কবির। অনুরোধে সাড়া দিয়ে এফডিআর খুলতে রাজি হন কনা দে। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তা ‘ভুয়া সিল ও সই’ দিয়ে তাঁকে একটি রসিদ দেন এবং কৌশলে একটি চেকে সই করিয়ে নেন। গত ১৮ এপ্রিল কনা দে তাঁর এফডিআরের বিপরীতে কোনো ঋণসুবিধা পাবেন কি-না জানতে ব্যাংকে খোঁজখবর নেন। তখন ব্যাংক থেকে জানানো হয়, তাঁর নামে কোনো এফডিআর নেই।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দাবি, কনার কাছ থেকে নেওয়া চেকের মাধ্যমে ইফতেখারুল টাকাগুলো তুলে ফেলেছেন। এভাবে অনন্যা বড়ুয়া, রূপম বড়ুয়া, সুপ্রভা বড়ুয়া, জেসমিন ইউসুফ ও আবু সাঈদসহ ২৫ জন গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মামলায় ইবিএল ও আর নিজাম রোড শাখার ব্যবস্থাপক মো. ইফতেখারুল কবির এবং ওই শাখার ব্যাংক কর্মকর্তা সামিউল শাহেদ চৌধুরীসহ সাতজনকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরষ্পর যোগসাজশে জাল কাগজের মাধ্যমে ও আর নিজাম রোড শাখা থেকে গ্রাহকের ৭ কোটি ৯৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। একইভাবে বাকি টাকা চান্দগাঁও শাখা থেকে আত্মসাৎ করা হয়। ওই দুই শাখায় গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় থানায় মামলা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ বলছে ‘ভুল’ হয়েছে
এ ধরনের মামলা কেন নিলেন জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আবদুর রহিম জয়নিউজকে বলেন, ভুলে আমরা মামলা নিয়ে ফেলেছি। আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর কাগজপত্র দুদকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেব।
ভুলে মামলার নেওয়ার অভিন্ন তথ্য দেন চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরীও।
আদালত সূত্র জানায়, মামলাগুলোর অনুলিপি নিয়ম অনুযায়ী থানা থেকে আদালতে আসার পর পুলিশের ভুলটি উঠে আসে। চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু সালেম মোহাম্মদ নোমান ১৮ আগস্ট এক আদেশে উল্লেখ করেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে থানা-পুলিশ অভিযোগটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করে তা ডিবি পুলিশকে তদন্তের জন্য দিয়েছে। যা দুদক আইন ও বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই অবস্থায় দুদককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগ ও কাগজপত্র পাঠানোর জন্য থানা-পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হলো।’
টাকা ফেরত চান ক্ষতিগ্রস্তরা
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, শীর্ষ কর্তাদের বাঁচাতেই পুলিশের কাছে মামলা নিয়ে গেছে ইবিএল কর্তৃপক্ষ। কারণ এত বড় একটি প্রতারণা ব্যাংকের দুই কর্মকর্তার মাধ্যমে কখনোই সম্ভব নয়। যেখানে ব্যাংকের প্রতিটি লেনদেনে শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর থাকা আবশ্যক। এছাড়া প্রতিবছর দেশের প্রতিটি ব্যাংককে বার্ষিক লেনদেনের হিসাব দিতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। ইবিএল কীভাবে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটকে পাশ কাটিয়ে গেল সেটিও রহস্যজনক।
ক্ষতিগ্রস্থ কনা দে জয়নিউজকে বলেন, আমি ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়েছি। টাকা জমার রশিদও তারা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরও ছিল। এখন ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ চক্র যদি টাকা আত্মসাৎ করে ফেলে এর দায়তো আমার নয়। এগুলো আমার আজীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয়, আমি টাকা ফেরত চাই।
বোমা ফাটালেন অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে কেন্দ্রীয় কারাগারে যান জয়নিউজ প্রতিবেদক। কারাগারেই কথা হয় অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ইফতেখার কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি কোনো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা নই যে, আমি বাঁশি বাজিয়েছি আর সবাই মোহগ্রস্ত হয়ে আমাকে টাকা দিয়ে গেছে। যা কিছু হয়েছে তা ব্যাংকিং নিয়মকানুন মেনেই হয়েছে। সমস্ত কিছু ব্যাংকের ৩৯ জনের অথরাইজেশনের মাধ্যমে হয়েছে এবং সর্বশেষ অথরাইজেশন ঢাকা হেড অফিস থেকে পাওয়ার পর লেনদেন সম্পন্ন করা হয়। এতকিছু কীভাবে আমার একার পক্ষে সম্ভব? আমাকে অন্যায়ভাবে জেলখানায় আটক করিয়েছে তারা।
তিনি বলেন, ব্যাংকে তদন্ত চলাকালীন সময়ে আমার কাছ থেকে অনেক সাদা কাগজ এবং স্ট্যাম্পে জোর করে সাক্ষর নিয়ে রেখেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আমার পরিবারকে গুম করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছে। এছাড়া যে ১৩ কোটি টাকার কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে ১১ কোটি টাকা আমি ব্যাংকে জমা করেছি। আর ২ কোটি টাকা ব্যাংকের সবাই মিলে আত্মসাৎ করেছে। এখন আমার কাছে তারা ১৩ কোটি টাকা দাবি করছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বের হয়েছিল সেগুলোর তদন্ত করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ব্যাংকের বাইরে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা কেউ জড়িত আছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ব্যাংকিং কার্যক্রমে ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাড়া বাইরের সাধারণ জনগণ কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে? যাদের আসামি করা হয়েছে তারা সবাই ব্যাংকের গ্রাহক। চাঁন্দগাও শাখার বর্তমান ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পারভেজ, পূর্বের চাঁন্দগাও ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন ও এরিয়া হেড ইফতেখার উদ্দিনসহ চট্টগ্রাম ও ঢাকা হেড অফিসের ৩৯ জনের সাক্ষরে অনুমোদন করা হয়েছিল ওইসব লেনদেন। ব্যাংকিং টার্গেট পূরণের জন্যই এগুলো করা হতো। যার কারণে সবার প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট এবং ব্রাঞ্চের লক্ষ্য পূরণ হতো।
কনা দে’র জমা হওয়া টাকার বিপরীতে দেওয়া রশিদের সিল-স্বাক্ষর ‘জাল’ বলছেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে ইফতেখার কবির বলেন, কনা দে’কে যে রশিদ দেওয়া হয়েছে তা ব্যাংকের। সেখানে যে স্বাক্ষর রয়েছে তাও ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার। এই রশিদের একটি কপি গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে, আরেকটি কপি ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে। যদি রশিদটি জাল হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ এটি গ্রহণ করলেন কেন। আবার তিন বছর পরই কেন বলছেন, এটি জাল।
এদিকে জামিনে থাকা ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত প্রায়োরিটি ম্যানেজার সামিউল সাহেদ চৌধুরী জয়নিউজকে বলেন, আমি তখন জিইসি ব্রাঞ্চে কর্মরত ছিলাম। আমার পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে এক টাকারও দুর্নীতি নেই। ব্যাংক আমাকে অন্যায়ভাবে সাসপেন্ড করেছে। আমাকে কোনো প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তো দিচ্ছেই না তার উপর এনওসি দিবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে। অথচ যে ব্রাঞ্চ থেকে এই অপকর্ম হয়েছে এক ইফতেখার ছাড়া সবাই তাদের নিজ নিজ পদে বহালতবিয়তে রয়েছেন।
আমি কী ইস্টার্ন ব্যাংকে চাকরি করি?
ব্যাংকের মামলায় আসামি ইবিএলের গ্রাহক ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন বাপ্পীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জয়নিউজকে বলেন, ভাই আমি একজন ব্যবসায়ী। আমি সুনামের সঙ্গে বিগত ১৬ বছর ধরে এই শহরে ব্যবসা করে আসছি। ইস্টার্ন ব্যাংকে এক যুগ ধরে আমার একটি একাউন্ট আছে। এছাড়া আমার স্ত্রীরও একটি একাউন্ট আছে, যেটির বয়স ৭ বছর। ব্যাংক কর্মকর্তা ইফতেখার কবিরের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে প্রায়ই তিনি আমার কাছ থেকে কিছু লভ্যাংশ দিবে বলে টাকা ধার নিতেন। পরবর্তীতে লভ্যাংশসহ যথাসময়ে টাকা ফেরত দিতেন। এখন এসব লেনদেন দেখিয়ে ব্যাংক বলছে আমিও টাকা আত্মসাতের সঙ্গে দায়ী।
তিনি বলেন, আমি কীভাবে তাকে আত্মসাতে সহযোগিতা করতে পারি? আমি কী ইস্টার্ন ব্যাংকে চাকরি করি? নাকি ইফতেখার আমাকে অনৈতিকভাবে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা লোন পাইয়ে দিয়েছেন ব্যাংক থেকে যা আমি আত্মসাৎ করেছি। তারা নিজেরাই এসব কাণ্ড ঘটিয়ে আমাদের উপর দোষ চাপানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এরিয়া হেড বললেন…
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ইবিএল চট্টগ্রামের এরিয়া হেড ইফতেখার উদ্দিন জয়নিউজকে বলেন, বিষয়টি আদালতে তদন্তাধীন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।
দুদকের মামলা থানায় কেন করলেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এগুলো ফোনে বলা যাবে না। আপনি আমার অফিসে আসেন। চা-নাস্তা খান। তারপর সরাসরি বলব।
তদন্ত করবে দুদক
বিষয়টির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চট্টগ্রামের পরিচালক মাহমুদ হাসান জয়নিউজকে বলেন, আদালত নির্দেশ দেওয়ার পর পুলিশ অভিযোগটি দুদককে ফেরত দেয়। থানায় রেকর্ড হওয়ায় করণীয় জানতে দুদক প্রধান কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। মামলার শুনানি শুরু হলে সব বিষয়েই তদন্ত করা হবে।
জয়নিউজ