এক নিখাদ স্বনির্মিত মানুষ সরদার প্যাটেল। তাঁর জীবনকাহিনী সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতার নজির।
১৮৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর প্রভাবশালী পতিদার সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম। শিক্ষাজীবনের শুরু গুজরাটে। এরপর সিদ্ধান্ত নেন লন্ডনে গিয়ে আইন পড়বেন। কিন্তু পিতার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তাঁর পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। ইস্পাত কঠোর সংকল্পের বলে, যে সংকল্প শেষদিন পর্যন্ত ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তরুণ প্যাটেল ‘আইন পরীক্ষার জন্য একাগ্রভাবে পড়াশোনা করেন, যার কারণে ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার জন্য তাঁর পরিবারকে অর্থব্যয় করতে হয়নি।’
১৯১২ সালের জুন মাসে প্যাটেল ইংল্যান্ডের মিডল টেম্পল থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। এরপর রেকর্ড সময় আড়াই বছরের মধ্যে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। দুর্দান্ত আইনি পরামর্শের কারণে তাঁর একটি নিজস্ব গ্রাহকমণ্ডলী তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তিনি অচিরেই সবার কাঙ্খিত আইনজীবীতে পরিণত হন। এরপর তিনি চেয়েছিলেন, সমাজের জন্য কিছু করতে, যার দ্বারা একটি স্থায়ী পরম্পরা রেখে যেতে পারেন।
‘‘এই দেশের ইতিহাসে আজকের মতো এমন সংহতি আর কোনোদিন দেখা যায়নি। অতীতে ভারতের ইতিহাসে দেখা গেছে এবং যদি আমরা অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই, তাহলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা ও সুসংহত রাখা আমাদের দায়িত্ব। যে স্বাধীনতার জন্য বহুলোক অসামান্য আত্মত্যাগ করেছেন।”
– সরদার বল্লভভাই প্যাটেল
‘সন্দেহ নেই যে, আমার প্রসার এখন বেড়ে চলেছে। আমি পুরসভাতেও বড় কিছু করতে পারছি। কিন্তু আমার এই প্রসার কাল থাকতেও পারে আবার নাও পারে। আমার টাকা কাল শেষ হয়ে যাবে, আমার যারা উত্তরাধিকারী, তারাই এই টাকা উড়িয়ে দেবে। বরং তাদের জন্য টাকার চেয়ে আরও ভালো একটি উত্তরাধিকার আমি রেখে যেতে চাই।’
প্যাটেল তাঁর জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কথা পরবর্তীতে লিখেছেন, যে সময় তিনি দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
গান্ধির সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্ত
১৯১৫ সালে হঠাৎ পাওয়া সুযোগে আহমেদাবাদের গুজরাট ক্লাবে মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে একটি বৈঠকে দেশের জন্য কাজ করতে তাঁকে আরো দৃঢ় করে। মহাত্মা গান্ধির জীবন ও দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর একান্ত অনুসারিতে পরিণত হন প্যাটেল এবং তাঁর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন।
তিনি একটি একটি সফল ‘কর দেব না’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। যার পরিণতিতে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কৃষকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
কৃষকদের সংগঠিত করায় প্যাটেলের বীরোচিত ভূমিকার কারণে তাঁকে সরদার খেতাব দেওয়া হয়, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় যার অর্থ নেতা।
সরদার প্যাটেল পরবর্তীতে অনেকবার বঞ্চিত ও নিপীড়িত কৃষকদের অধিকার আদায়ে অহিংস প্রতিরোধের গান্ধিবাদি পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধির সূচনা করা লবণ-সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে সরদার প্যাটেলকে কারাবন্দি করা হয়।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও মহাত্মা গান্ধির একনিষ্ঠ সমর্থক ও মিত্র থেকে যান প্যাটেল। ১৯৪২ সালে প্রভাবশালী নেতারা গান্ধির ভারত ছাড় আন্দোলনের সংঙ্গে যুক্ত অসহযোগ আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে স্বাধীনতা সংগ্রামের মতবিরোধ প্রকাশে চলে আসে। সরদার প্যাটেল বলিষ্ঠকণ্ঠে গান্ধিকে সমর্থন জানিয়ে আসতে থাকেন এবং কার্যত বাধ্য হয়েই সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিকে ভারত ছাড় আন্দোলনে সমর্থন দিতে হয়।
ভারতকে ঐক্যবদ্ধকারী: লৌহমানব
জাতিগঠনে দুর্দান্ত সাংগঠনিক যোগ্যতা ও অদম্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার কারণে সরদার প্যাটেল ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ঐক্যবদ্ধকারী প্যাটেলকে যথার্থই স্মরণ করা হয় তাঁর লৌহকঠিন সংকল্প ও দৃঢ়তার জন্য, যার দ্বারা তিনি ৫০০’র বেশি দেশীয় রাজ্যকে সমন্বিত করে ফেডারেল ইন্ডিয়ার কাঠামো প্রস্তুত করেন। এই স্মরণীয় কীর্তির কারণেই তিনি ব্যাপক শ্রদ্ধা ও সম্মানে ভূষিত হন, যার কারণে তাঁকে ভারতের লৌহমানব বলা হয়ে থাকে।
সমাজ সংস্কারক প্যাটেল
রাষ্ট্রকে জাতীয় উন্নয়ন ও উত্থানের কারিগর হিসেবে দেখার ধারণাটি প্যাটেলের চিন্তারই বাস্তবায়ন। রাষ্ট্রের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর প্রচারিত রাজনৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়। জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম কেবল একটি রাষ্ট্রের স্তম্ভই নয়, বরং রাষ্ট্রকে একসঙ্গে টিকিয়ে রাখার জন্যও এই উপাদান দু’টি আবশ্যক। প্যাটেলের চিন্তায় ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হতে হবে রাষ্ট্রের সংবিধানের ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
বিশ্ব্যায়নকারী হিসেবে প্যাটেল
সরদার প্যাটেল ছিলেন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণকারী, যিনি প্রতিকী আদর্শবাদের পরিবর্তে একটি বাস্তবমুখী বৈদেশিকনীতির সুপারিশ করেন। তিনি উপর্যুপরি পরামর্শ দিয়ে গেছেন যেন, দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি ব্যাহত হয় এমন কোনো পদক্ষেপ কিছুতেই গ্রহণ করা না হয়।
প্যাটেলের ঐতিহ্য: জাতি গঠনকারী
সরদার প্যাটেল যদিও ভারতের স্বাধীনতার পর মাত্র আড়াই বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু এই অল্প কয়েক মাসেই তিনি একটি আধুনিক, শক্তিশালী ও স্বনির্ভর ভারতের ধারণা তৈরি করে যান। ভারতের একক রাজ্যগুলোকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করার কৃতিত্বের জন্য প্রায়শ জার্মানীর কিংবদন্তী নেতা অটো ভ্যান বিসমার্কের সঙ্গে তুলনীয় প্যাটেল জাতিগঠনে নানাভাবে ভূমিকা রাখেন। তিনি ভারতের সংবিধান প্রণয়নকারীদের সভায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ভিমরাও রামজি আম্বেদকরের নিয়োগে এবং সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক বলয় হতে নেতাদের যুক্ত করতে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
খুব বেশি মানুষ জানেন না যে, সরদার প্যাটেল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ভারতের সিভিল সার্ভিসের স্বায়ত্ত্বশাসন ও নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে সংবিধানে অনুচ্ছেদ যুক্ত করে যান।
স্বাধীনতার গান
সরদার প্যাটেলের মৃত্যুর কয়েক দশক পরও, ভারতের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের কথা ভারতের পুনরুত্থানে আত্মনিয়োগকারীদের উজ্জীবিত করে। এই দিনে কিংবদন্তিতুল্য এই মহান ব্যক্তির প্রতি আজও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন অব্যাহত রয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৪৭ সালের ২৭ জানুয়ারি সংখ্যার প্রচ্ছদ করা হয় সরদার প্যাটেলের ওপর এবং তার শিরোনাম দেওয়া হয়- ‘দ্য বস’।
সরদার প্যাটেলকে ১৯৯১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারত রত্ন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর বাহ্যিক জীবনে এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিরলসভাবে তিনি নাগরিকদের সৎ আদর্শিক জীবনযাপন করতে আঁকুতি জানিয়ে এসেছেন। আর আবেদন রেখেছেন যেন তারা ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশ ও সমাজের স্বার্থকে সবসময়ে উচ্চস্থান দেন।
১৯৪৮ সালে আলওয়ারের এক সভায় সরদার প্যাটেল যে ভাষণ দেন, তা যেন এই জাতিকে স্বতস্ফূর্তভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, একজন মুক্ত নাগরিকের দায়িত্ব হলো- সব নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং তার দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
‘বন্দুকের জোরে প্রতিবেশি রাষ্ট্র বা অন্য বিদেশি রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। কিন্তু দেশের ভেতরে, একজন স্বাধীন নাগরিকের নাগরিকদের সততা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি একাই পারে ষড়যন্ত্রী ও স্বার্থপর দল ও ব্যক্তিদের থেকে দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে।’