বিশ্বজুড়ে মোট পণ্যের অর্ধেক কনটেইনারে করে পরিবহন হয় রেলপথে। কিন্তু বাংলাদেশে রেলপথে কনটেইনার পরিবহন হয় মাত্র তিন ভাগ। অথচ রেলপথে কনটেইনার পরিবহন যেমন নিরাপদ তেমনি সাশ্রয়ীও।
এদিকে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগোলে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ ভাগ কনটেইনার যায় ঢাকা ও এর আশপাশে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকাগামী কনটেইনারের ৬৬ ভাগ যায় সড়কপথে। মাত্র তিন ভাগ যায় রেলপথে। আর বাকি এক ভাগ নদীপথে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দেশের আমদানি-রপ্তানি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও পরিবহন। তবে সে হারে বাড়ছে না রেলপথে পরিবহন।
রেলপথে বেশি কনটেইনার পরিবহন করা গেলে কমবে পরিবহন ব্যয়। একইসঙ্গে সড়কের উপর চাপও কমবে। বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও।
গত ৮ জুন পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অনুষ্ঠানে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বলেন, রেলপথে পণ্য পরিবহন করা হলে সড়কের ওপর চাপ কমবে। রেল যোগাযোগকে আরও উন্নত করার জন্য ২০৪৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরা গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলোতে ডাবল লাইন করছি। যাতে রেলপথেই ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্য পরিবহন করতে পারেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকা শহরে দিনের বেলায় ট্রাক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ অবস্থায় শহরের কেন্দ্রস্থল কমলাপুরে অবস্থিত রেলভিত্তিক একমাত্র আইসিডি ব্যবহারে নানা সমস্যায় পড়তে হয় আমদানি ও রপ্তানিকারকদের। মূলত এই সমস্যার কারণেই রেলপথে বাড়েনি কাঙ্ক্ষিত পরিবহন।
সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী খান জয়নিউজকে বলেন, আমরা চাই গ্রাহকদের পণ্যের নিরাপত্তা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার পাঠাতে রেলে বুকিং দিলে অনেকসময় ১০-১৫ দিন কনটেইনার পড়ে থাকে। আমদানিকারক ঠিক সময়ে পণ্য হাতে না পেয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। মূলত রেলের বগি সংকটের কারণেই এটি হচ্ছে। বন্দর ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি আরো তৎপর হয়ে বগি সংখ্যা বাড়াতে পারেন তবেই ব্যবসায়ীরা রেলপথে পণ্য পাঠাতে উৎসাহিত হবেন।
এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রয়োজনীয় কনটেইনার না পাওয়ায় বন্দরের বগি বাড়ানোর প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছে না রেলওয়ে। প্রতিবছর ঈদের আগে দেশে কনটেইনার আমদানি বেড়ে যায়। সারাবছর যদি এ চিত্র থাকত তবেই রেলওয়ে বগি বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে পারতো।
প্রতিদিন দুই ট্রিপে বন্দর থেকে রেলপথে প্রায় ২৪০ থেকে ২৮০টি কনটেইনার কমলাপুর আইসিডিতে পৌঁছায়। এই পরিমাণ কনটেইনার যদি সড়কপথে যেত তাহলে পরিবেশ দুষণের পাশাপাশি বাড়তো সড়কে অতিরিক্ত চাপ। ভারি পণ্যবাহী কনটেইনার যখন ট্রাকে সড়কপথে যায়, তখন সড়কের অবকাঠামোতেও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়ে সড়কের আয়ু কমে যায়।
ব্যবসায়ীদের মতে, রেলপথে কনটেইনারের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো নিরাপদ হলেও ব্যয় বেশি। বন্দর থেকে সাভারে কনটেইনার পাঠাতে ১৬ হাজার টাকায় ট্রাকে পাঠানো সম্ভব হলেও কমলাপুর আইসিডি থেকে ট্রাকে কনটেইনার পাঠাতে আবারো খরচ পড়ে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। এছাড়া কনটেইনার উঠা-নামার খরচ এবং ঝামেলাতো আছেই। মূলত এ কারণে রেলপথে পণ্য পরিবহনে উৎসাহিত হচ্ছে না ব্যবসায়ীরা।
ভারতের অন্ধপ্রদেশের বিশাখাপত্তম বন্দর দিয়ে প্রতিদিন সকাল ৭টা ও দুপুর ১টা এবং সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১টায় সারাদেশে রেলপথে কনটইেনার পরিবহন করা হয়। এতে আমদানি রপ্তানিকারকরা মোটামুটি ধারণা করতে পারেন কখন তাদের কনটেইনার গন্তব্যে পৌঁছাবে। বন্দর ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি এ ধরণের ব্যবস্থা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে পারে তবেই রেলপথে কনটইেনার পরিবহন আরো বাড়তে পারে।
অপরদিকে ব্যবসায়ীদের সঠিক পরিকল্পনার অভাবকেও রেলপথে পণ্য পাঠানো কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন বন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তিনি জয়নিউজকে বলেন, রমজানের আগে থেকেই আমাদের দেশে হঠাৎ পণ্য আমদানি বেড়ে যায়। এ ধারাবাহিকতা সারাবছর থাকে না। যদি পরিকল্পনামাফিক আমদানি হতো তবে উভয়পক্ষের জন্য সুবিধা হতো। যেমন চীনে নববর্ষের সময় একটানা অফিস-আদালত থেকে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকে টানা ১৭ দিন। ইউরোপে খ্রিস্টমাস উপলক্ষে টানা বন্ধ থাকে ৫ দিন। উভয় দেশের সরকার ও ব্যবসায়ীরা বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিবহন বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরে জানুয়ারিতে বন্দর থেকে রেলপথে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ৮ হাজার ১২৬ টিইউএস, ফেব্রুয়ারিতে ৭ হাজার ৮৯, মার্চে ৭ হাজার ৩০৪, এপ্রিলে ৬ হাজার ৫৭১, মে’তে ৭ হাজার ৫৬২, জুনে ৭ হাজার ৪৪৯, জুলাইয়ে ৯ হাজার ৩৮৬, আগস্টে ৭ হাজার ৮৩১ এবং সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৩৩৮ টিইউএস।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জয়নিউজকে বলেন, বর্তমানে প্রতিবারে ১২০ থেকে ১৪০টি কনটেইনার কমলাপুর আইসিডিতে পাঠানো সম্ভব হলেও আগামীতে যাতে ২০০ কনটেইনার পাঠানো যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
জয়নিউজ/এসআই