২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে মানোন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, অর্জন করেছেন উল্লেখযোগ্য অবস্থান। গত বছরও ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের যোগ্য ছিলেন। কিন্তু এবার পরীক্ষার পর শুনতে পান মানোন্নয়নের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে না। এভাবে উত্তীর্ণ একজনের অভিযোগের সূত্র ধরে জবাব খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মূলত এ বছরের ভর্তি আবেদনের শর্ত গতবছর থেকে সামান্য ভিন্ন হওয়ায় সৃষ্ট বিভ্রান্তি থেকে এই সমস্যায় পড়েছেন ওই শিক্ষার্থী। কিন্তু বড় ধরণের অসঙ্গতি রয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ায়। নিয়মানুযায়ী যারা ‘আবেদনের অযোগ্য’ এমন শিক্ষার্থীরাও অংশ নিচ্ছে পরীক্ষায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনদের মর্জিতে হঠাৎ আবেদনের অযোগ্য বিবেচিত হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। কিন্তু ‘অযোগ্য’রা আবেদন থেকে বাদ পড়েনি। ভর্তি বিজ্ঞপ্তির ‘অস্পষ্টতা’য় আবেদন করে বসেছে অনেকেই।
অথচ তাদের বাদ দেওয়ার দায়িত্ব আবেদন প্রক্রিয়ায় জড়িত আইসিটি সেলকে না দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্বে রেখেছেন ডিনরা।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এএফএম আওরঙ্গজেব ও আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বিএম আবু নোমানসহ বেশ কয়েকজন ডিন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশের না শর্তে জানান, বর্তমান রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে বেয়াকায়দায় ফেলতে বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা।
যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছে অযোগ্যরা
গত ৩ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার এসএম আকবর হোছাইন স্বাক্ষরিত ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যা প্রণয়ন করেছে ডিন কমিটি। এর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ভর্তির যোগ্যতা’ অংশে বলা হয়, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ১ম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির জন্য যারা ২০১৮ সালের উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষার ফলাফলে আবেদনের যোগ্য ছিল না তবে ২০১৯ সালের উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষায় (মানোন্নয়ন) অংশগ্রহণ করে যোগ্যতা অর্জন করেছে তারা আবেদনের যোগ্য বিবেচিত হবে।’ একই অংশে মানোন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণকৃত শিক্ষার্থীরাও যোগ্য বিবেচিত হবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
অর্থাৎ ২০১৮ সালে যারা যোগ্য ছিল না, মানোন্নয়ন পরীক্ষার মাধ্যমে শর্ত পূরণ করতে পারলে তবেই পরীক্ষা দিতে পারবে তারা। আর যারা গত বছর যোগ্য ছিল, এ বছর তাদের কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু গত ২৭ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে দেখা যায়, ২০১৮ সালের উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের যোগ্য ছিল, এমনকি পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছে এমন শিক্ষার্থীরাও এ বছর আবেদন করতে পেরেছে। শুধু তাই নয় নিয়মানুযায়ী এই আবেদনের ‘অযোগ্য’ প্রার্থীরা রীতিমত অংশ নিয়েছে পরীক্ষাতেও। অন্তত এমন চারজন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার তথ্য রয়েছে জয়নিউজের কাছে।
এ নিয়মবহির্ভূত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নে সাফ না করে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তারা জানান, পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলেও ভর্তির পূর্বে বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ে আটকে যাবে এসব শিক্ষার্থী। তাহলে খোদ ‘আবেদনের অযোগ্য’ শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে কেন এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার এসএম আকবর হোছাইন জয়নিউজকে বলেন, গতবছর যদি তার যোগ্যতা থাকে, কিন্তু পরীক্ষা দিয়েছে অথবা দেয়নি যাই হোক এ বছর ভর্তি হতে পারবে না। যদি গতবছর অযোগ্য থাকে, এ বছর মানোন্নয়ন দিয়ে যোগ্য হয়েছে তাহলে পরীক্ষা দিতে পারবে৷
তিনি বলেন, আবেদনকারী ২০১৯ সালের এইচএসসি রোল নম্বর দিয়ে আবেদন করছে, সেজন্য সিস্টেম তাকে গ্রহণ করে নিচ্ছে। ২০১৮ সালে সে যোগ্য ছিল কি অযোগ্য ছিল সেটা বাছাইয়ের প্রক্রিয়া রাখা হয়নি। তবে বিষয়টি আইসিটি সেল ভালভাবে বলতে পারবে। তারা করেছে এই সিস্টেমটা। তারা হয়তো তাদের সার্ভার দিয়ে তাদের (আবেদনকারীদের) ‘না’ করে দিতে পারেনি।
সার্কুলারে যেহেতু ‘আবেদনের যোগ্য’ বলা হয়েছে, সেহেতু বাছাই প্রক্রিয়া আবেদনের সময় না হয়ে ভর্তির সময় কেন হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. হানিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
তিনি বলেন, আমাদের সব সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছেন তারা (আইসিটি সেল)। এটা তারাই ভাল বলতে পারবেন।
যোগাযোগ করা হলে আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. হানিফ সিদ্দিকী জয়নিউজকে বলেন, আবেদন করতে পারছে কারণ বোর্ডের ডাটা সিস্টেমে তার ২০১৯ সালের ডাটা প্রবেশ করছে। এটা দেখা হচ্ছে বর্তমানে সে যোগ্য, না অযোগ্য। কিন্তু তার পুরাতন ডাটা, আগে সে যোগ্য ছিল না অযোগ্য ছিল সেটা যাচাই করা তো সম্ভব না। কেননা ডাটা যখন দিচ্ছে তখন সে নতুন ছয়টা ডাটা দিচ্ছে। কিন্তু পুরাতন ডাটা সে দিচ্ছে না৷ এটা আবেদনের সময় তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটাতে সে আবেদনের যোগ্য কিনা। আমরা সার্কুলার দিয়েছি। অনলাইনে আবেদনের সময় বারবার উল্লেখ করেছি ‘আবেদনের পূর্বে লক্ষ্য করুন’। তাকে (আবেদনকারীকে) সচেতন হতে হবে। যেহেতু সার্কুলারে উল্লেখ করা হচ্ছে এটা তাকে খেয়াল করতে হবে। এটা তো ঐচ্ছিক কোনো বিষয় না। সুনির্দিষ্ট নিয়মের আলোকে হচ্ছে।
তাহলে যাচাই কখন হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা পুরাতন (মানোন্নয়ন) আছে, তাদের তালিকাটা প্রত্যেক ইউনিটে পাঠিয়ে দিই৷ তারা ম্যানুয়ালি যাচাই করে অযোগ্যদের বাদ দিয়ে দেন। আইসিটি সেলকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আবেদনের অযোগ্যদের আবেদনের সময় যাচাই করা হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের যাচাই করতে হলে ডাবল সিস্টেমে যেতে হবে। একসঙ্গে এ বছর এবং আগের বছর। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আবার আমার হাতে যতটুকু সময় ছিল এর মধ্যে সফটওয়্যার ডেভলপ করা সম্ভব না। কারণ নতুন সিদ্ধান্ত হয়েছে ২ সেপ্টেম্বর রাতে আর ভর্তির আবেদন শুরু হয়ে গেছে ৮ সেপ্টেম্বর। এই সময়ের মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপ করা অসম্ভব।
যে নিয়ম সম্ভব হচ্ছে না সেটা কেন তৈরি করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ডিন কমিটির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, পলিসি আমরা তৈরি করি না। এটা ডিনদের তৈরি নয়ম। সিদ্ধান্ত হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপ করে ভিন্ন সিস্টেম তৈরি করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ডিন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী জয়নিউজকে বলেন, আমরা কোনো যাচাই-বাছাই করি না। যা যাচাই করার সব আইসিটি সেল করে। তারা মানোন্নয়নের কোনো তালিকা আমাদের দেয় না। শুধু কোটা আর পরীক্ষার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল থেকে প্রাপ্তনম্বরের তালিকা দেয়। এছাড়া তারা সব ‘পাশ’ করে, আমরা শুধু বাস্তবায়ন করি। কিন্তু পরে ইউনিট বা ফ্যাকাল্টি যাচাই না করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ইনস্টিটিউট থেকে যাচাই-বাছাই করা হয় বলে স্বীকার করেন তিনি।
তবে যাচাই বাছাইয়ের কাজ ইউনিট প্রধানদের দায়িত্ব বলে জয়নিউজকে নিশ্চিত করেছেন একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার এসএম আকবর হোছাইন।
উল্লেখ্য, এ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন শুরু হয় ৮ সেপ্টেম্বর। এজন্য প্রত্যেক আবেদনকারীকে প্রতিটি ইউনিটে আবেদন বাবদ গুণতে হয়েছে ৪৭৫ টাকা। এছাড়া ৭৫ টাকা সার্ভিস চার্জও দিতে হয়েছে। সর্বমোট আবেদন করেছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭০ জন। এদের মধ্যে মানোন্নয়নের পরীক্ষার্থী রয়েছে ১১ হাজার ৭৪১ জন।