রাতারাতি লাখপতি হতে প্রতারণার অভিনব ফাঁদের কথা প্রায়সময় শোনা যায়। কিন্তু ভিক্ষুকদের সন্তান টার্গেট করে লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন- এ কথা কখনো কেউ শুনেছেন কি-না সন্দেহ।
অবাক ঠেকলেও সত্যি, অসহায় ভিক্ষুকদের বাচ্চা নিয়ে জঘন্য এ প্রতারণা করছে একটি চক্র।
এ চক্রের মূল কাজ, ফুটপাত, মসজিদ কিংবা মাজার প্রাঙ্গণে ভিক্ষা করা নারীদের বাচ্চা চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এজন্য তাদের টার্গেটে থাকে ভিক্ষুকদের ১ মাস থেকে ১০ মাস বয়সের বাচ্চা।
কখনও ভিক্ষুক নারীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, আবার কখনো তাদের অসহায়ত্বে ব্যথিত হওয়ার ভান করে তারা বাচ্চা চুরি করে। এরপর লাখ টাকায় সেই বাচ্চা বিক্রি করে দেয় নিঃসন্তান দম্পতির কাছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতারকচক্রটি দম্পতি বুঝে একেকটি বাচ্চার জন্য আদায় করে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর শিশুপুত্র হলে দাম হয়ে যায় দ্বিগুণ।
স্বামীহারা দুই সন্তানের জননী শিরিন বেগম । ৬ মাস বয়সী ছেলে ও ৭ বছর বয়সি এক কন্যা সন্তান রয়েছে তার। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারানোর পর দুই সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিতে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি।
গত ১৫ মার্চ নগরের ইপিজেড থানার নেভী কলোনি সংলগ্ন ফুটপাতে ৬ মাস বয়সী শিশু শুভকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন শিরিন। ভিক্ষা করার সময় অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি শিরিনের কাছে গিয়ে তার অসহায়ত্বে ব্যথিত হওয়ার ভান করে তাকে জুস খেতে দেন। জুস পান করার কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারান শিরিন।
অজ্ঞান শিরিনকে নগরের আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তিও করান ওই দুই ব্যক্তি। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর শিরিন আর শুভকে খুঁজে পাননি।
সুস্থ হয়ে শিরিন ১৮ মার্চ নগরের ইপিজেড থানায় হাজির হয়ে তার ৬ মাস বয়সি শিশু অপহরণের অভিযোগ করেন। এরপর শিশু উদ্ধারে নামে ইপিজেড থানা পুলিশ ।
পুলিশ প্রথমে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বাচ্চাটিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া দুই ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। এদের একজন ইকবাল হোসেন (৩০) এবং অপরজন জাফর সাদেক প্রকাশ আফসার (৩৫)।
গত ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে শিশু অপহরণকারী চক্রের সদস্য ইকবাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ইকবাল পুলিশের কাছে স্বীকার করে, সে এবং তার গুরু জাফর সাদেক কৌশলে শিরিনকে ঘুমের ওষুধ মেশানো জুস খাইয়ে তার ৬ মাস বয়সী শিশুকে অপহরণ করে।
গত ৩ নভেম্বর অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা জাফর সাদেকও পুলিশের জালে ধরা পড়ে। সাদেককে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
সাদেক জানায়, তারা শিশুটিকে চুরি করে প্রথমে নগরের মেহেদিবাগের ন্যাশনাল হাসপাতাল ও সিগমা ল্যাবের টেকনোলজিস্ট পারভিন আক্তারের হেফাজতে রাখে। এরপর তাদের অপর সদস্য সালেহা বেগম আলেয়ার (৫২) মাধ্যমে ক্রেতা খুঁজতে থাকে। পরে আলেয়া ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার কাশেম আলী টেন্ডল বাড়ির নিঃসন্তান গৃহবধূ তাসমিনা আক্তার জেলীর কাছে দেড় লাখ টাকায় শিশুটিকে বিক্রি করে দেয়।
শিশুর ক্রেতা তাসমিনা আক্তার জয়নিউজকে বলেন, বিয়ের ৮ বছর হলেও আমাদের সংসারে সন্তান আসেনি । মা-বাবা নেই এমন একটি সন্তান পালন করতে অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেছি। পরে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আলেয়ার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকায় শিশুটিকে কিনে নিই।
তিনি আরো বলেন, শিশুটিকে কেনার আগে আমাকে জানানো হয়েছিল ক্যান্সারে শিশুটির মা মারা গেছে। দেখাশোনার কেউ না থাকায় তার বাবা শিশুটিকে দত্তক দিতে চাইছে। তারা প্রথমে বাচ্চাটির জন্য আড়াই লাখ টাকা দাবি করে। পরে দেড় লাখ টাকায় স্ট্যাম্প করে শিশুটিকে নিয়েছি। শিশুটি অপহরণ করে বিক্রি করা হয়েছে সেটি আমি জানতাম না।
এদিকে এ ঘটনায় শনিবার (২৩ নভেম্বর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সদর দপ্তরে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। সেখানে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, এই চক্রটি গরিব ও নিম্নবিত্ত নারীদের টার্গেট করে। বাচ্চা চুরি করতে এরা বিভিন্ন ছলনার আশ্রয় নেয়। আদর করতে কোলে নেওয়ার ভান করে মাকে বলে তুমি এটা করো ওটা করো। এই ফাঁকে এরা বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায়।
আমেনা বেগম বলেন , কিছুদিন আগে ইপিজেড থানায় একটি বাচ্চা উদ্ধার হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের আচরণে সন্দেহ হয়। তখন ইপিজেড থানায় বাচ্চা চুরির ৬ মাস আগের আরেকটি ঘটনায় তাদের ইনক্লুড করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে সেই বাচ্চাটিও তারা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে। ওই বাচ্চা চুরির ঘটনা থেকে আমরা পুরো চক্রটিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো মায়ের বাচ্চা মিসিং থাকে দয়া করে আমাদের জানাবেন। আমরা এদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। নিম্নবিত্ত মায়েদের কাছে আমার অনুরোধ এরকম কারো প্রলোভনে পড়ে তারা যেন কেউ কিছু না খান।
জয়নিউজ