২০১৬ সালের ১ জুলাই- সাপ্তাহিক ছুটির দিন, সঙ্গে রমজানও শেষের দিকে। সব মিলিয়ে ঈদের আমেজে ছিল ঢাকাবাসী। ইফতার পর্যন্তও সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। তখনো কেউ জানতো না কী ভয়াবহতার মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।
সেদিন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ নিহত হন ২২ জন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়াও জঙ্গিদের ছোঁড়া গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেকে।
পরদিন (২ জুলাই) সকালে সেনা কমান্ডোদের উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর একজন পাচক নিহত হন। এই অভিযানের মধ্যদিয়ে শেষ হয় শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি দশা। রেস্তোরাঁর আটক আরেক কর্মী জাকির হোসেন শাওন পরে হাসপাতালে মারা যান।
আরো পড়ুন: হলি আর্টিজান: ৩ বছরের অপেক্ষার অবসান
তিন বছর আগের ওই হামলার ঘটনায় আজ (বুধবার) দুপুরে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রায় হবে।
কি ঘটেছিল ভয়াল সেই রাতে, আসুন দেখে নিই-
সন্ধ্যার পর প্রথমে খবর পাওয়া যায় রাজধানীর গুলশানে পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি চলছে। তখনও ধারণা করা যায়নি আসলে কী ঘটছে।
সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই পুলিশ সদস্যসহ আহত ৬।
রাত ৯টার পরে খবর পাওয়া যায় গোলাগুলির ঘটনায় গুলশান এলাকায় নিরাপত্তা ব্যাপক জোরদার করা হয়েছে।
ঘটনা যে ভয়াবহ হচ্ছে তার আঁচ পাওয়া যায় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিনের নিহত হওয়ার খবরের মধ্যেদিয়ে।
এরইমধ্যে পরিষ্কার হতে থাকে এখানে বড় ধরনের একটি ঘটনা ঘটছে। হলি আর্টিজানে দেশি-বিদেশি বেশকিছু মানুষ খেতে এসেছিলেন। দুর্বৃত্তরা তাদের জিম্মি করেছে।
রাত ১১টার পর র্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ জানান, জিম্মিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করতে চান তিনি।
ওই রেস্তোরাঁয় পরিবারের চার সদস্যসহ আটকা পড়া ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ করিম তার চাচা আনোয়ার হোসেনকে ফোন করে জানান, পুলিশকে অনুরোধ করুন ভেতরে যেন গুলি না চালায়। গুলি চালালে তারা (সন্ত্রাসীরা) আমাদের মেরে ফেলবে।
ওসি সালাউদ্দিনের পর মৃত্যুর খবর আসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামের।
জিম্মি করে রাখার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেয় মার্কিন দূতাবাস।
জিম্মিদশাতে থেকেই ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে একজন লেখেন- ‘সবাই দোয়া করেন, জানি না বাঁচমু না মইরা যামু’।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর চোখও ততক্ষণে বাংলাদেশের দিকে। কূটনৈতিক জোনে হামলার ওই ঘটনা ব্রেকিং নিউজের পাশপাশি লাইভ টেলিকাস্টও শুরু করে তারা
এক টুইটবার্তায় হামলার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সংগঠন আনসার আল ইসলাম।
রাত দেঢ়টার দিকে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়।
হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয়।
আনসার আল ইসলামের পর হামলা দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সাইট ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ওই খবর দেয়।
সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, ডিবি, সোয়াত, সিআইডি, ফায়ার বিগ্রেড ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিলেও জিম্মিদের উদ্ধারে কীভাবে অভিযান পরিচালিত হবে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছিল।
জিম্মিদের উদ্ধারে ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে সিলেট থেকে রওনা দেয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো টিম।
শনিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সিলেট থেকে গুলশানে এসে পৌঁছায় সেনাবাহিনীর কমান্ডো টিম।
শনিবার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে জিম্মিদের উদ্ধারে অপারেশন থান্ডারবোল্ট শুরু হয়। আসতে খাকে মুহুর্মুহু গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ।
সকাল পৌনে ৯টার দিকে ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটির ডিসি জসিম উদ্দিন জানান, একজন একজন করে জিম্মিদের উদ্ধার করা হচ্ছে।
অভিযান শেষ হওয়ার কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মিজানুর রহমান।
দুপুরে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, সমন্বিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ছয় সন্ত্রাসী নিহত ও একজনকে জীবিত গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দুপুর দেড়টার দিকে সেনা সদর দফতরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সেনা কর্মকর্তা নাইম আশরাফ চৌধুরী বলেন, জিম্মিদের উদ্ধারে অপারেশন ‘থান্ডারবোল্ট’ শুরুর আগেই ২০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়।
ভয়াবহ ওই হামলার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিহতদের স্মরণে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন তিনি।
এরপর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে অংশ নেওয়া নিহত পাঁচ বন্দুকধারীর ছবি প্রকাশ করে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স।
জয়নিউজ/এসআই
