চট্টগ্রামকে নিয়ে আমার স্বপ্ন আছে। বে-টার্মিনালের পরিকল্পনা কুমিরা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। এ এলাকায় যাতে কেউ স্থাপনা গড়তে না পারে, এব্যাপারে এখনই ঘোষণা দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম।
রোববার (১৯) জানুয়ারি সকালে বন্দর ভবনের সম্মেলন কক্ষে বন্দর ব্যবহারকারিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বের উন্নত বন্দরকে মডেল ধরে এগুতে হবে। কিভাবে আগামীর ১০০ বছরের সমস্যা মোকাবেলা করা যায় তা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। তবে ৫০ বছর আগে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করে যদি পদক্ষেপ নেওয়া যেতো বর্তমানে এত সমস্যা মোকাবিলা করতে হতো না।
মেজর রফিকুল আলাদা সড়ক পথের ব্যবস্থা থাকতে হবে জানিয়ে বলেন, বন্দরের কার্গোর জন্য ডেলিগেটেড সড়ক ও রেলপথ থাকতে হবে। এটি সবচেয়ে জরুরি। হামবুর্গ পোর্টে দেখেছি ১৪টি দেশের জন্য হাজার হাজার কিলোমিটারের ডেলিগেটেড রেললাইন রয়েছে। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে জিডিপিতে দেড় শতাংশ গ্রোথ বাড়বে। বিশ্বব্যাংকের ১৫০ বিলিয়নের পরিকল্পনা রয়েছে ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের জন্য।
তিনি আরো বলেন, কর্ণফুলীর তলদেশে গ্র্যাব ড্রেজার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এরপর ক্যাপিটাল ড্রেজিং হবে। সব খালের মুখে স্টিলের নেট দিতে হবে। বন্দর লাইফলাইন হচ্ছে নদী। নদী না থাকলে বন্দর থাকবে না। শিপিং ও অর্থমন্ত্রী যৌথভাবে কাজ করলে বন্দর কাস্টম কেন্দ্রিক সমস্যা থাকবে না। এখন বিচ্ছিন্নভাবে কাজ হচ্ছে বন্দর ও কাস্টমসে।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহাবুবুল আলম বলেন, বন্দরের কন্টেইনার ও বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং যে হারে বাড়ছে তা সামাল দিতে এখন বে-টামিনাল নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি মেজর রফিকের উদ্দেশে বলেন, আপনি ১৮ জানুয়ারি বলেছিলেন, বে-টার্মিনালকে ফাস্টট্রাকে নেওয়ার জন্য কাজ করবেন। আমরা জানতে চাই তা কখন নেবেন, তার জন্য সময় বেধে দিতে হবে। এ ব্যাপারে সংসদীয় কমিটিকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ভারতে ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে আগামীতে সড়কের বেহালদশা হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমি অনেক আগে থেকেই বলেছিলাম সড়ককে ৮ লাইন করতে। ট্রান্সশিপমেন্ট দিতে হবে ভালো কথা, সড়ক যদি ৮ লাইন করা না হয় ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে সড়কের অবস্থা হবে আরো নাজুক। বন্দরে কোনো ট্রাক টার্মিনাল নেই। প্রতিদিন ৭ হাজারের অধিক ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করে। এ জন্য টার্মিনাল করতে হবে। একইসঙ্গে কর্ণফুলীকে বাঁচাতে, নাব্যতা বাড়াতে ড্রেজিং যেমন করতে হবে, তেমনি নদীর দুপাশ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এএম মাহবুব চৌধুরী বলেন, সারাদুনিয়া অনলাইনে চলে গেছে। অনলাইনে কনটেইনার ইন্ডেন্ড নিতে হবে। অফডকে ল্যান্ডিং চার্জ নিচ্ছে আমদানিকারকের কাছ থেকে। বন্দর চার্জ বাড়িয়েছিলো এক-এগারোর সময়। উচ্চমূল্য এখনো দিচ্ছি। আমাদের এখন ক্রেতা কমে গেছে। ফলে ২১ শতাংশ রপ্তানি কমে গেছে।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি এমএ সালাম বলেন, বন্দরের লিড টাইম, ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। বন্দরে প্রচুর খালি কনটেইনার পড়ে আছে। এসব খালি করতে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহেযোগিতা চাই। ৯৪ শতাংশ কনটেইনার যায় সড়ক পথে। রেলে কনটেইনারের সিরিয়াল পেতে ১৫ দিন লাগে। প্রয়োজনে কনটেইনার পরিবহন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যায়। কাস্টমসের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এতবড় সভায় কাস্টমের সহকারী কমিশনার এসেছেন। উচ্চপদের কেউ আসতে পারতেন।
সিএন্ডএফ এজেন্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু বলেন, বন্দরের লোকের চেয়ে অতিথি বেশি। বন্দরের নিজস্ব নিরাপওা বাহিনীর চেয়ে আনসার বেশি। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য যেমন টেন্ডার করে, একইসঙ্গে লেবার হ্যান্ডলিয়ের জন্য ও টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। সঙ্গে বাড়াতে হবে হ্যান্ডলিংয়ের যন্ত্রপাতি।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী, কনটেইনার দ্রুত সরবরাহ নেওয়ার জন্য আমদানিকারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
কাস্টমসের সহকারী কমিশনার বলেন, ৯৮ শতাংশ পণ্য পরীক্ষা ছাড়াই যাচ্ছে। গোপন সংবাদ থাকলে কনটেইনার লক করা হয়। দিনে এ ধরনের ৪-৫টি কনটেইনারের বেশি নয়। শুল্কায়ন ২৪ ঘণ্টা চললেও জেটিতে হচ্ছে না মন্তব্য করে বন্দরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়েন তিনি।
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আশা করতে পারি আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দর লয়েল লিস্টে এগিয়ে ৬২ থেকে ৫৬-৫৭ আসবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বন্দরে এখন কনটেইনার আছে ৩২ হাজার টিইইউস। এরমধ্যে ১ হাজার দিন বয়সীও আছে। দ্রুত কনটেইনার না নিলে আইনের আশ্রয় নেবো আমরা। ১৭টি জেটি আছে, ৬টি নির্মাণাধীন আছে। জেটি তৈরি হবে চাহিদার উপর। ট্রান্সশিপমেন্ট বিষয়ে কলকাতার সঙ্গে দুটি ট্রায়াল রান হবে। তা জানুয়ারিতে হওয়ার কথা।
বন্দর সিবিএ সভাপতি মো. আবুল মনছুর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকেই আমরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি। প্রলয়ংকরী নার্গিস ও আইলাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা দিনরাত ইয়ার্ডে মালামাল পাহারা দিয়েছি। বর্তমানে বন্দরে কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই।
বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম বলেন, আমরা যখন দুই ঈদে ১৮ দিন বন্দর খোলা রেখে পাহারা দিই তখন গার্মেন্টস মালিকরা তাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেন। ফলে কনটেইনার ডেলিভারী না নেওয়াতে জট লেগে যায়। বিজিএমইয়ের পরিচালকদের দাবির জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বন্দরকে প্লেনের মতো চিন্তা করতে হবে। তাই একদিন আগে কনটেইনারের অ্যাসাইনমেন্ট নিতে হবে।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন সংসদীয় কমিটির সদস্য রণজিৎ কুমার রায়, মাহফুজুর রহমান, ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, এসএম শাহজাদা, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আব্দুছ ছাত্তার, উপ-সচিব বেগম মালেকা পারভীন, ড. দয়াল চাঁদ মণ্ডল, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপ-পরিচালক আবদুল জব্বার ও সিনিয়র সহকারী সচিব এসএম আমিনুল ইসলাম, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ, সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলম, সদস্য (প্রকৌশল) ক্যাপ্টেন মহিদুল হাসান চৌধুরী, হারবার মেরিন কমডোর শফিউল বারী, চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান, সচিব মো. ওমর ফারুক, ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান ও উপ সচিব আজিজুল মওলা।