একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটি ফের রাতের আঁধারে নগরের দুটি থানা কমিটি দিয়েছে। কমিটির শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্বে এসেছে কাউন্সিলর নির্বাচনে অস্ত্রধারীরা। এছাড়া সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে ছাত্রদল সভাপতির ভাই।
এ নিয়ে বিব্রত নগর আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছেন এবং অন্য দলের কাউকে দলে না ভিড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ঠিক সেই সময়ে তাদেরকে দিয়ে দুটি থানা কমিটি গঠন আওয়ামী লীগকে বিব্রত করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোনো ঘোষণা এবং আলাপ-আলোচনা ছাড়া বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে নগরের চান্দগাঁও ও ডবলমুরিং থানা কমিটির ঘোষণা করে মেয়াদোত্তীর্ণ নগর কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
ঘোষিত দুই থানা কমিটির সভাপতি , সাধারণ সম্পাদক শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এর আগে ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বরও বন্দর, পতেঙ্গা, আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছিল একপেশিভাবে। সেখানেও সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীদের।
অস্ত্র নিয়ে ভোটকেন্দ্র দখলকারী রাকিব ডবলমুরিংয়ের নেতৃত্বে
ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে ফরহাদ সায়েম ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে রাকিব হায়দারকে। কমিটিতে ১৩ জনকে সহসভাপতি, সাতজনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নয়জনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে।
এছাড়া ডবলমুরিং থানা থেকে জহুরুল কাইয়ুম ফয়সাল ও শুভ ঘোষকে নগর ছাত্রলীগের কমিটিতে সহসম্পাদক পদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করা রাকিব হায়দার গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা বিবি মরিয়মের পক্ষে অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্র পাহারা দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। তার অস্ত্রধারী ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নির্বাচনের দিন।
রাকিব হায়দার নগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের অনুসারী। কাউন্সিলর প্রার্থী বিবি মরিয়ম জাকারিয়া দস্তগীরের বড় বোন। ঘোষিত কমিটির সভাপতি , সাধারণ সম্পাদক শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী।
ছাত্রদল নেতার ভাইকে সাধারণ সম্পাদক
চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে নুরুন নবী শাহেদকে ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে মো. শহীদুল আলমকে। এছাড়া চান্দগাঁও থানা থেকে এম হাসান আলী, কপিল কর ও ইমরান হোসেন জনিকে নগর কমিটিকে সহ-সম্পাদক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে যাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে তার বড় ভাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল আলমের বড় ভাই তৌহিদুল আলম চান্দগাঁও ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক।
২০১১ সালে মোহাম্মদ নওশাদকে সভাপতি ও তৌহিদুল আলমকে সাধারণ সম্পাদক করে চান্দগাঁও ওয়ার্ড ছাত্রদলের কমিটি করা হয়। এছাড়া তৌহিদুল আলম হাজেরা-তজু কলেজ ছাত্রদলের দায়িত্বে ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন নগর বিএনপির কয়েকজন নেতা।
এছাড়া সহসভাপতি নয়ন উদ্দিন গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা বিবি মরিয়মের পক্ষে অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্র পাহারা দিয়ে সমালোচিত হয়েছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল।
এদিকে ঘোষিত কমিটির একাধিক নেতা পদত্যাগ করেছেন। অনেকে জানেন না কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এছাড়া সম্মেলন ছাড়া অগণতান্ত্রিকভাবে রাতের আন্ধকারে কমিটি গঠনকে প্রত্যাখান করেছে অনেকে।
ঘোষিত কমিটির সহসভাপতি আমির হোসেন পদত্যাগ করে জয়নিউজকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবের সংগঠন। এ সংগঠনে অগণতান্ত্রিক ও রাতের অন্ধকারে কমিটি গঠনের নজির নেই। এছাড়া আমি তখন হাজেরা তজুতে ছাত্রলীগ করি তখন শহিদুল আলমের ভাই তৌহিদুল আলম ছিল সেই কলেজের ছাত্রদল নেতা। এছাড়া সহসভাপতি নয়নের অস্ত্রবাজির ছবি সব গণমাধ্যমে এসেছে। ছাত্রদল নেতার ভাই ও অস্ত্রধারীদের কমিটিতে আমি নিজেকে রাখতে চাই না।
প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ছাত্রলীগ থেকে অনেক দূরে নগর ছাত্রলীগ
নগর ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে দীর্ঘদিন অসন্তোষ রয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে। নগর ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতাদের বাদ দিয়ে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের অনুগতদের কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কোনো ঘোষণা ছাড়া রাতের অন্ধকারে ফেসবুকে কমিটি ঘোষণা অনেককে বিস্মিত করেছে।
নগর ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক নাছির উদ্দিন কুতুবি জয়নিউজকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রলীগের কমিটির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আমরা সবাই বিব্রত। তাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেকদিন। এছাড়া অধিকাংশ নেতা বিবাহিত। যাদের মেয়াদ নেয়, তারা যদি থানা কমিটি দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে তবে তা খুবই মর্মান্তিক এবং সংগঠন বিরোধী। তাই অবিলম্বে নগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি।
নগর কমিটির অধিকাংশই বিবাহিত!
২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সংসদ। এর প্রায় একবছর পর ২০১৪ সালে ২৯১ জনের সম্মেলনবিহীন কমিটি পেয়েছিল নগর ছাত্রলীগ।
জানা গেছে, বর্তমান নগর কমিটির ৫৬ জন সদস্যই বিবাহিত। দেড়শরও বেশি নেতার বয়স সংগঠনের নিয়মসিদ্ধ নয়। ছাত্রনেতাদের অনেকেই ব্যবসায়ী। বেশ কয়েকজন নেতা পড়ালেখা ছেড়েছেন অনেকদিন আগে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বরাবর বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযোগ দিয়েছেন নগর ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পূর্বে সংঘাতের আশঙ্কা
মার্চে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের কারণে ইতোমধ্যে নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন স্থগিত করেছিল কেন্দ্র। কারণ কমিটি গঠন নিয়ে যাতে কোনো অরাজকতা ও সংঘাত না হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের এমন কমিটি গঠন সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ইয়াছির আরাফাত জয়নিউজকে বলেন, এতদিন ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু একতরফা কমিটির মাধ্যমে ছাত্রলীগের ঐক্যকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন নগর কমিটির উচিত হবে স্বসম্মানে সম্মেলন দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা।
এব্যাপারে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বারবার ফোন করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
জয়নিউজ/বিআর