কক্সবাজারের চকরিয়ায় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, মারধর ও লুটপাটের ঘটনায় ১০ পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহারকৃত পুলিশ সদস্যরা হলেন চার পুলিশ কর্মকর্তা ও ছয়জন কনস্টেবল।
বৃহস্পতিবার ( ৫ মার্চ) দুপুর দেড়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের নির্দেশে বৃহস্পতিবার রাতে তাদের প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ঘটনায় সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (চকরিয়া সার্কেল) কাজী মো. মতিউল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা য়ায়, চকরিয়ার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদী প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় চকরিয়া থানার একদল পুলিশ।
এ সময় পুলিশ সদস্যরা অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ভাঙচুর করে।
এছাড়াও পুলিশ সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধার কুটিরের ছয়টি কক্ষের আসবাবপত্র ভাঙচুরের পাশাপাশি তল্লাশির নামে বাড়ির আলমিরা ভেঙে ২০ ভরি ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ চার লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে বলে দাবি করেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। পুলিশের বেদড়ক পিটুনীতে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিসহ আটজন আহত হয়।
এ ঘটনার পর বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে ঘটনার সঙ্গে জড়িত চকরিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল ইসলাস, এসআই মিজান, এসআই তৃষ্ট লাল বিশ্বাস, এএসআই জেড রহমান ও ৬জন কনস্টেবলসহ ১০জনকে প্রত্যাহার করা হয়।
পুলিশের হামলায় আহতরা হলেন, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর স্ত্রী ও স্থানীয় লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নেচারা বেগম (৬০), ছেলে মুরাদুল করিম সিফাত (২৭), পুত্রবধূ ও লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম সেলিমের স্ত্রী শাহনা আক্তার শানু (৩০), ফরিদা ইয়াসমিন (৩২), ফাতেমা ইয়াসমিন (২৮), সাবাহ নুর তাবাহ (১৮), সৌদি প্রবাসী নাতি হাসান আবুল কালাম (২৩), নাতি আর্শেনুল করিম সুহা (৯) ও নাতি আনোয়ারুল মোস্তাফিজ শিহাব (১৪)। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত মুরাদুল ইসলাম সিফাতকে আশংকাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যান্যরা চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসাসেবা নেন।
প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নেচারা বেগম জয়নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে আকস্মিকভাবে চকরিয়া থানার একদল পুলিশ আমাদের বাড়িতে (মুক্তিযোদ্ধা কুঠির) এসে প্রধান ফটকের গেট বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে ঢুকে তল্লাশির নামে ব্যাপক ভাঙচুর ও তাণ্ডব চালায়। এ সময় পুলিশ দলের সদস্যরা অশ্লীল গালিগালজ করে বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ভাঙচুরের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধার কুটিরের ছয়টি কক্ষের জানালা ও আসবাবপত্র ব্যাপক ভাঙচুর করে।
তিনি আরও বলেন, তল্লাশির নামে পুলিশ সদস্যরা বাড়ির আলমিরা ভেঙে ২০ ভরি ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ চার লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা আমাকে, আমার ছেলে মুরাদুল ইসলাম সিফাতকে ও ছেলেদের স্ত্রী যথাক্রমে শাহনা আক্তার শানু ফরিদা ইয়াসমিন, ফাতেমা ইয়াসমিন, সাবাহ নুর তাবাহ এবং নাতি স্কুলছাত্র আনোয়ারুল মোস্তাফিজ শিহাব ও নাতনি আর্শেনুল করিম সুহাকে পিটিয়ে আহত করে।
তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ছেলে সিফাতকে আশংকাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নেচারা বেগম আরো বলেন, পরে পুলিশ আমার ছেলে লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম সেলিমের স্ত্রী শাহনা আক্তার শানুকে আটক করে থানায় নিয়ে গেলেও পরে ছেড়ে দেয়।
দিনদুপুরে একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে পুলিশের এ ধরনের বর্বরোচিত ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা ’৭১ সালের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মিরাজ জয়নিউজকে বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা গোলাম মোস্তফা কাইছারের ইন্ধনে চকরিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসান, এসআই তুষ্টলাল বিশ্বাস ও এএসআই জেট রহমানের নেতৃত্বে ১০-১৫জন পুলিশ বৃহস্পতিবার দুপুরে আমাদের বাড়িতে (মুক্তিযোদ্ধা কুঠির) ঢুকে ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালায়। এসময় পুলিশ সদ্যবিবাহিত আমার ছোটভাই মুরাদুল করিম সিফাতকে তার স্ত্রীর সামনে বেধড়ক পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। বর্তমানে সে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। আমি এ নারকীয় ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান জয়নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ ওই এলাকায় একজন আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযানে গেলে আসামিপক্ষের লোকজন পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পরে পুলিশ হামলাকারীদের খুঁজতে গিয়ে ভুল বুঝাবুঝি থেকে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এ সময় পুলিশের কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ করে। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে এ ঘটনার পর চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার (চকরিয়া সার্কেল) কাজী মো. মতিউল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান, চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনসহ চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় তারা এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী জয়নিউজকে বলেন, কক্সবাজারের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদি আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর বাড়িতে সংগঠিত এ ঘটনা খুবই ন্যাক্কারজনক। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।