দুই বছরের কমিটি পার করছে ছয় বছর। ৪১ ওয়ার্ডের হাতেগোনা কয়েকটিতে কমিটি দিয়ে দায় সেরেছেন তারা! ২৯১ জনের কমিটির প্রায় ২০০ জনই বিয়ে করে এখন সংসারী। গঠন করতে পারেননি কোন থানা কমিটিও। নগর ছাত্রলীগের ঐতিহ্যবাহী ‘ঘাটি’ এমইএস কলেজ, সিটি কলেজ, ইসলামিয়া কলেজের কোন নেতাকর্মীকে তারা দিতে পারেননি ‘সাংগঠনিক পরিচয়’! এমনকি যে প্রতিষ্ঠানে নিজেদের রাজনীতির হাতেখড়ি সে প্রতিষ্ঠানেই কমিটি দিতে পারেননি তারা! এতসব ব্যর্থতার গল্প চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের। যে কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু আর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
চট্টগ্রামের এমইএস কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, ইসলামিয়া কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করছে হাজারো শিক্ষার্থী। যাদের কোন সাংগঠনিক পরিচয় নেই। অন্যদিকে মাত্র দুই বছর ধরে ছাত্রলীগের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া চট্টগ্রাম কলেজে কমিটি দিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন নগর ছাত্রলীগ নেতারা। অথচ এখন পর্যন্ত সতেরো হাজার শিক্ষার্থীর এ কলেজে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেননি ছাত্রলীগ নেতারা।
চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের উপ দফতর সম্পাদক সনেট চক্রবর্তী জয়নিউজকে বলেন, নগর ছাত্রলীগ ছয় বছর ধরে সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীর সঙ্গে প্রহসন করেছে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নিজেদের কলেজের কমিটি গঠন করতে পারেননি। এক যুগের বেশি সময় পার করার পরেও সিটি কলেজ, এমইএস কলেজ, ইসলামিয়া কলেজের কমিটি গঠন করতে পারেননি। তারা কোন থানা কমিটি গঠন করেননি। ২৯১ জনের কমিটির ২০০ জনই বিয়ে করেছে। তাদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী।
তিনি অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগ রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে শুরু করেছে বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যে গ্রুপিং শুরু করে নগর ছাত্রলীগের নেতারা। গ্রুপিং নিরসন না করে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে পরামর্শ না করে রাতের আঁধারে এই কলেজের কমিটি গঠন করা সংগঠনের সাথে প্রহসন।
ইমরান আহমেদ ইমু। সরকারি সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে গঠিত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি মনোনীত করা হয় তাকে। কমিটির মেয়াদ ছিল দুই বছরের। অথচ ছয় বছর সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ এ পদে থেকেও নগরের কোন থানার কমিটি গঠনে উদ্যোগ নেননি তিনি। এমনকি ইমুর যে কলেজে ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি সেই কলেজের কমিটিও তিনি গঠন করতে পারেননি!
একই অভিযোগ নগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের বিরুদ্ধেও। এই ছাত্রলীগ নেতার পড়াশোনা ওমরগনি এমইএস কলেজে। এই কলেজটির কমিটিও গঠন করেনি তাদের কমিটি। এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের হাজারো নেতাকর্মীর কারও ভাগ্যে জোটেনি সাংগঠনিক পদবি।
নগর ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগ প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি শুরু করেছে ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। সেদিন শিবিরের সাথে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার সময় ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর হাতাহাতি হয়। পরে তা রুপ নেয় সংঘর্ষে। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তায় শিবিরকে বিতাড়িত করে ছাত্রলীগ পুরোদমে ওই কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ছাত্রলীগের দাবির মুখে হোস্টেলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে এই কলেজে ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপ সক্রিয় হয়।
প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী এ তিনটি গ্রুপ নিয়মিত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কলেজটির নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে যাওয়ার পর থেকে অর্ধশতাধিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায় তারা। নগর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের এ কোন্দল নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছেন। কোন্দলের নিরসন না করেই কমিটি ঘোষণার পর থেকে চট্টগ্রাম কলেজে শুরু হয়েছে অস্থিতিশীলতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিটি করতে না পারলেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন-ফিসহ বিভিন্ন অযুহাতে অতিরিক্ত টাকা আদায় করার প্রতিবাদে আন্দোলন সংগ্রামে দেখা গেছে ইমু-রনির ছাত্রলীগকে। এ বিষয়গুলোকে সংগঠনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের পরিচায়ক মনে করা হলেও সাংগঠনিক ভিত্তি অর্জনে এ কমিটির দৃশ্যমান কোন সফলতা নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রলীগ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব ফেরাতে এসব আন্দোলন ভূমিকা রাখলেও সংগঠনে ছাত্রদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন তারা।
নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমুর মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কল কেটে দেন। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ জাকারিয়া দস্তগীর জয়নিউজকে বলেন, সিটি কলেজ, এমইএস কলেজ, ইসলামিয়া কলেজ চট্টগ্রামের প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির তীর্থস্থান। আওয়ামী লীগের বড় বড় কর্মসূচিতে এই কলেজগুলোর হাজার হাজার নেতা-কর্মী উপস্থিত হয়ে পূর্ণতা এনে দেয়। এ কলেজগুলোতে মৌলবাদের কোন ঝুঁকি নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম কলেজ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নীলনকশা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই আমরা মনে করেছি এ কলেজটিতে কমিটি গঠন করে সংগঠনকে গতিশীল করতে হবে।
দস্তগীর আরও বলেন, আমরা কমিটি গঠনের আগে সিনিয়র ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাইয়ের অনুসারী আব্দুল্লাহ আল মামুন, মিঠুন মল্লিক, ওয়াহেদ রাসেলের সাথে আমি নিজেও আলাপ করেছি। এরপর আমরা সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কমিটি গঠন করেছি। হয়তো সবাইকে সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক করতে পারিনি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার সাথে জাকারিয়া দস্তগীরের কথা হয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, বীর চট্টলার অবিসংবাদিত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে থাকলে আপনারা কি চট্টগ্রাম কলেজের কমিটি গঠনের আগে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন না? তিনি প্রতি উত্তরে জানালেন, হ্যাঁ নিতাম। আমি তখন বললাম, বতর্মানে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরৗ ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের সাথে পরামর্শ করতে আপনাদের সমস্যা কোথায়? তখন জাকারিয়া আমাকে কোন উত্তর দিলেন না।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ১৫ বছর ধরে সিটি কলেজ, এমইএস কলেজে কমিটি নেই। যতই শক্ত অবস্থান থাকুক, কমিটি না দেওয়া কি সাংগঠনিক ব্যর্থতা নয়। হাজারো নেতাকর্মীর কি রাজনৈতিক পরিচয়ের দরকার নেই? চট্টগ্রাম কলেজ নিয়ে কেন এতো টেনশন তাদের? শিবিরের তিন কর্মী, ছাত্রদলের এক জন চিহ্নিত কর্মীকে দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করে কি শিবিরের স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি?
এর আগে সোমবার রাতে মাহমুদুল করিমকে সভাপতি ও সুভাষ মল্লিক সবুজকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ২৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
জয়নিউজ/অভি/হোসেন