নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের চেনার মাধ্যম ‘ইউনিফর্ম’। ইউনিফর্ম দেখেই বলা যায়- কে কোন বাহিনীর সদস্য। তবে নিয়মের তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র ইউনিফর্ম বিক্রি করায় বাড়ছে অপরাধ। ইউনিফর্ম পরে অপরাধীদের কেউ হয়ে যাচ্ছেন পুলিশ, কেউ বনে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্য।
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পোশাক-সরঞ্জাম সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। তাই বাধ্য হয়ে অনেককে খোলা বাজার থেকে এসব সরঞ্জাম কিনতে হয়। আর এ চাহিদার জন্য নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, বিএমএ এলাকায় গড়ে উঠেছে সামরিকসহ বিভিন্ন বাহিনীর পোশাক সরঞ্জাম বিক্রির মার্কেট।
অভিযোগ আছে, যথাযথ তদারকি ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই এসব দোকান থেকে বিক্রি হয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনী পোশাক ও সরঞ্জাম। এভাবে অপরাধীদের হাতেও চলে যাচ্ছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম। এ অভিযোগ খোদ পুলিশের।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এসব দোকানে পুলিশের ইউনিফর্ম, হ্যান্ডকাপ, র্যাঙ্ক ব্যাজ, রিবন, নেইম প্লেটসহ তেরো আইটেম কিট বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দোকান রয়েছে বাযেজিদ বোস্তমীর আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটে। শুধু এই মার্কেটে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি করার অন্তত পনেরটি দোকান।
এদিকে পুলিশের পোশাক ব্যবহার করে অপরাধ ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশ সদর দফতরকে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার ওই রির্পোটে খোলা বাজারে ইউনিফর্ম ও সরঞ্জাম বিক্রি নিরুৎসাহিত করার কথা উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে সুপারিশ করা হয়, নিজেদের তত্ত্বাবধানে পুলিশ লাইনের ভেতরে টেইলার্স ও দোকান স্থাপন করে ইউনিফর্মসহ অন্যান্য সামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা করার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অপরাধীরা বিভিন্ন সময় পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম ব্যবহার অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ভয়-ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে হয়রানি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ সংঘটিত করা হয় বিভিন্ন বাহিনীর ইউনিফর্মে। এ অপরাধীদের কারণে সুনাম নষ্ট হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই দোকনগুলো থেকে মাত্র হাজার দেড়েক টাকায় পুলিশের পোশাক পাওয়া যায়। হ্যান্ডকাপ ও রিভলবার ফোল্ডার মিলছে এক হাজার টাকা কিংবা তারও কমে।
অনলাইন দুনিয়া সয়লাব নানারকম ওয়াকিটকিতে। এ সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধীচক্র। তারা এসব সামগ্রী ব্যবহার করে অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। পরে দুই-একটি অপরাধীচক্র পাকড়াও হলেও বেশিরভাগই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে নিয়ম কানুন প্রণয়ন কিংবা আদেশ জারির কথা বলা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী পুলিশের পোশাক বিধিমালা-২০০৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধান তথা পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের (পিআরবি) ২০তম অধ্যায়ে পুলিশের পোশাক নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছ। যার কোনোটাই মানছে না খুচরা পর্যায়ের এসব দোকানদারেরা।
সাধারণত পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে এসআই (উপ-পরিদর্শক) পর্যন্ত পোশাক ও সরঞ্জম সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয়। অন্যদিকে পুলিশ ইন্সপেক্টর থেকে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিনে নিতে হয়।
এখানে বড় একটি সুযোগ নেয় অপরাধীরা। পুলিশ পরিচয়ে অনেকেই ইউনিফর্মসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনে নিচ্ছে। অন্যদিকে বিক্রেতারাও জানেন না নিয়ম সম্পর্কে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের মে মাসে পুলিশের আইজিপির পক্ষে এআইজি (লজিস্টিকস) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পুলিশের পোশাকের অপব্যবহার রোধ নিয়ে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, এয়ারপোর্ট পুলিশ (এপিবিএন) ও প্রধানন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি এন্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) ইন্সপেক্টর এবং অন্যান্য ইউনিটের এসআই ও তার নিচে পুলিশ সদস্যদের পোশাক সামগ্রী সরকারিভাবে কিনে ইস্যু করার কথা। কিন্তু প্রায় ছয় বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি এটি।
সংঘটিত কয়েকটি অপরাধ
ঘটনা ১: ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর আমানবাজার এলাকার একটি বাসায় প্রায় ছয় ঘণ্টা অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় ওই বাসা থেকে ১৯০ রাউন্ড গুলি, একটি এমকে ডাবলওয়ান স্নাইপার রাইফেল, বিস্ফোরক উপাদান ও সেনাবাহিনীর পোশাক উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন সদস্য মো. নাঈম (২৫), মো রাসেল (২৪) ও মো. ফয়সালকে (২৫)।
ঘটনা ২: গেল বছরের ১১ সেপ্টেম্বর নগরের বাকলিয়ায় আব্দুল লতিফ হাটখোলা মহিলা স্কুলের পাশ থেকে ডিবি পরিচয়ে একজনকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় প্রতারকচক্রের নয় সদস্যকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে চক্রটি তাদের কাছে ডিবি পুলিশের পোশাক ও আইডি কার্ড থাকার কথা জানায়। পরে অবশ্য তাদের বাসায় তল্লাশি করে কোনো আলামত উদ্ধার করতে পারেনি পুালিশ।
ওই সময়ের থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেজাম উদ্দীন জয়নিউজকে বলেন, পুলিশ তল্লাশি চালানোর আগেই সুকৌশলে তারা আলামতগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলে। তাই ওইসময় পোশাক, আইডি কার্ডসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা যায়নি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভুয়া পুলিশ, ডিবি আটকের খবর চাউর হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
ঘটনা ৩: চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বায়েজিদ থানার কথিত সোর্স সালাউদ্দীন ওরফে বাচাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে এলাকার বাসিন্দারা। সেসময় সোর্স সালাউদ্দীন ওরফে বাচাইয়ার কাছে পুলিশের হ্যান্ডকাফ থাকার কথা জানান তারা। এই হ্যান্ডকাফ দেখিয়ে লোকজনদের নানা ভয়-ভীতিসহ হয়রানি করতো সে। সোর্স বাচাইয়ার কাছে পুলিশের হ্যান্ডকাপ সম্বলিত একটি ছবি ফেইসবুকেও ভাইরাল হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বায়েজিদ থানার এএসআই শাহাদাত হোসেন ও এসআই সাইফুল হোসেনের সঙ্গে সখ্যতা ছিল সোর্স বাচাইয়ার। এর মধ্যে এএসআই শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে বাচাইয়ার কয়েকটি ছবিও ভাইরাল হয়। যেগুলো আপলোড হয় শাহাদাতের ব্যক্তিগত আইডি থেকে। যদিও পুলিশের এই দুই সদস্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তবে আপলোডকৃত ছবি এবং ভিডিও জয়নিউজের কাছে সংরক্ষিত আছে। সোর্স বাচাইয়া পুলিশের হ্যান্ডকাফ কোথায় পেল তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি ওই দুই পুলিশ সদস্য। বায়েজিদ থানা পুলিশও এ ঘটনার কোনো দায় নেয়নি। এ অবস্থায় পুলিশের হ্যান্ডকাফ সোর্সের হাতে কীভাবে গেল তা নিয়ে রহস্য থেকেই গেছে।
সংশ্লিষ্টরা কী বলছেন
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব) এমদাদুল ইসলাম জয়নিউজকে বলেন, পুলিশ বাহিনীর সুবিধার্থে খোলা বাজারে পোশাক-সরঞ্জাম বিক্রি করা হচ্ছে। এই বাহিনীর সদস্যদের পোশাক-সরঞ্জামের চাহিদা রয়েছে। একথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। তবে স্পর্শকাতর এসব সামগ্রী যাতে দুষ্টচক্রের হাতে না পড়ে সেদিকে সচেতেন হতে হবে। যারা বিক্রি করেন তাদেরকে এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে হবে। পত্রিকায়, টেলিভিশনে জনস্বার্থে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যেতে পারে। অপরাধীরা অপরাধ করার সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সচেতনতাই পারে এসব অপরাধ ঠেকাতে।
চট্টগ্রাম মোট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) শ্যামল কুমার নাথ জয়নিউজকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের পোশাক-সরঞ্জামসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার সময় সংশ্লিষ্ট দোকানে আইডি কার্ড প্রর্দশন করে কিনবে। কেউ যদি আইডি কার্ড দেখাতে না পারে তাহলে তার কাছে পণ্যের ব্যবহার সম্পর্কে জনতে চাইবে। এ অবস্থায় অপরাধের উদ্দেশ্যে কেউ এসব পণ্য কিনলে তারা ধরা পড়বে।
জয়নিউজ/পিডি