চলে গেলেন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। বৃহস্পতিবার (১৪ মে) বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে রাজধানী ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটে জন্ম নেওয়া এ সূর্যসন্তান সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক আর প্রগতিশীলতার চর্চায় জাতীয় এ অধ্যাপক ছিলেন অক্লান্ত সৈনিক। জাতীর এ সূর্যসন্তানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাঙালির প্রতিটি গৌরবের অধ্যায়, অহংকারের পাতায় তাঁর উজ্জ্বল, নির্ভীক উপস্থিতি। তিনি জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। শুধু জাতীয় অধ্যাপক নয়। ছিলেন জাতির অভিভাবক।
দেশভাগের সময় ওপার বাংলা থেকে পাড়ি এপারে। এরপর থেকে বাংলাদেশের এগিয়ে চলায় কোথায় নেই তাঁর দৃপ্ত পদচিহ্ন!
সক্রিয় অংশগ্রহণ বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম উন্মেষ ৫২’র ভাষা আন্দোলনে। সরব ছিলেন পাকিস্তান আমলে বাঙালির সব অধিকার আন্দোলনে। বহুবিধ ভূমিকায় অবদান রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। দায়িত্ব পালন করেন শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। পেশায় শিক্ষক হলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারে যুক্ত ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে।
দেশ স্বাধীনের পর শিক্ষকতার বাইরে গিয়েও ভূমিকা রাখেন জাতিরাষ্ট্র গঠনে। যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সঙ্গে। সাম্প্রদায়িক-স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনেও থেকেছেন সরব। শিক্ষকতার গণ্ডির ভেতরে থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষার উৎকর্ষে কাজ করে গেছেন নিরলস।
জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটে। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কলকাতায় হলেও দেশভাগের পর ভর্তি হন খুলনা জিলা স্কুলে। বছর খানেক পরেই ঢাকায় এসে ভর্তি হন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। এরপর শিক্ষাজীবন কেটেছে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপনায় আলোকিত হয়েছেন অগণিত বিদ্যার্থী। পাশাপাশি গবেষণাকর্মের মাধ্যমে তুলে এনেছেন আদি বাংলা সাহিত্যের নানা দিক।
গুনি এই মহান ব্যক্তিত্বের কাজের স্বীকৃতিতে মিলেছে দেশি-বিদেশি নানা পদক-পুরস্কার-সম্মাননায়। ভূষিত হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পুরস্কার। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার। প্রাপ্তির খাতায় আছে ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বেসামরিক পদক পদ্মভূষণ।
জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত লড়েছেন সাম্প্রদায়িক আর পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে, আওয়াজ তুলেছেন সুউচ্চ কণ্ঠে। মুক্তচিন্তার বাতিঘর হয়ে আলোকিত করেছেন সমাজকে, ভূমিকা রেখেছেন সাংস্কৃতিক জাগরণে, বাঙালিত্বের জয়গান। জাতীয় আর রাষ্ট্রজীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় প্রভাব রেখে গেছেন আজীবন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল মূল্যবোধের ধ্বজাধারী অক্লান্ত, অগ্রবর্তী সারথি, জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বাঙালি জাতি আজীবন কুর্নিশ জানাবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানকে- বিদায়বেলায় এই প্রত্যাশা।