এক সময়েই পুলিশ দেখলে মানুষ দূরে সরে গেলেও এখন পথের পাশে অনাহারী সেই মানুষগুলো সাহায্যের আশায় পুলিশের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। অদৃশ্য করোনাযুদ্ধে জনগণের কল্যাণে জীবনবাজি রেখে আমলাতান্ত্রিক প্রথা ভেঙে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সদস্যরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে নগর এলাকায় অত্যন্ত দূরদর্শীতার সঙ্গে সম্মুখভাবে এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার মো. মাহবুবর রহমান। তার অধীনস্ত ৭ হাজার বাহিনী নিয়ে নগরবাসীর কল্যাণে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ, করেছেন সফল বাস্তবায়নও।
সুবিধাভোগীরা জানান, করোনাকালে অসহায় মানুষদের পাশে সিএমপির অবস্থান ছিল দেখার মতো। এছাড়াও করোনা সচেতনতা বাড়াতে তারা যথেষ্ট কাজ করেছে। তা না হলে এই নগরে করোনার ভয়াবহতা আরও বাড়তো। করোনাকালে সিএমপির অবদান আজীবন মনে রাখবে নগরবাসী বলেও জানান তারা।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, করোনাকালের প্রথম দিন থেকে নগরবাসীর পাশে থেকেছি। অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষদের যে কোনো প্রয়োজনে নিজেকে নিয়োজিত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছি। যতুটুকু পেরেছি মানুষের জন্য কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করব।
সিএমপির জনসংযোগ শাখার তথ্য মতে, নগরে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তা অনুধাবণ করে সিএমপি কমিশনার গত মার্চের শেষ সপ্তাহে নগরের সমস্ত পর্যটন কেন্দ্র নিষিদ্ধ করেন। জনগণের মাঝে সচেতনার লক্ষ্যে বিশেষ মোবাইল টিম গঠন ও এলাকায় মাইকিং করেন।
বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি ও বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণে ‘নিরাপদ Stay Home, Stay Safe’ নামে মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে সিএমপি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ৫৫৫টি পরিবারের বাসায় ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলের ঝুড়ি পৌঁয়ে দেয় সিএমপি।
এছাড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পুলিশ সদস্য ও জনসাধারণকে জরুরি সহায়তা দিতে গঠন করা হয়েছে করোনাভাইরাস রেসপন্স টিম। সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফ হোসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল অফিসার, ফার্মাসিস্ট ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের এ টিম করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পিপিই ও অন্যান্য সরঞ্জাম ও দুটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নগরে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটাতে গ্রহণ করেছে সমন্বিত ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। সিএমপির নিজস্ব অর্থায়নের পাশাপাশি কিছু মানবিক প্রতিষ্ঠান এ কার্যক্রমে হাত বাড়িয়েছে। এর ফলে ৫০ হাজারেরও অধিক দরিদ্র পরিবার পেয়েছে সিএমপির ত্রাণ সামগ্রী।
করোনা সংক্রান্ত সচেতনতার লক্ষ্যে নগরের প্রায় ২৫৩টি মসজিদ থেকে এক যোগে প্রত্যেক নামাজের ওয়াক্তে প্রচারণা চালানো হয়। এছাড়াও জনসচেনতা বৃদ্ধিতে মসজিদের মুসল্লিদেরসহ প্রত্যেক এলাকায় লিফলেট বিতরণ করা হয়।
ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে সিএমপির উদ্যোগে কাঁচাবাজার স্থানান্তর কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নগরের ৩০টি অধিক কাঁচাবাজার ইতোমধ্যে স্থানান্তর করা হয়েছে।
‘দোকান যাবে আপনার ঘরে’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে সিএমপি কমিশনার মানবতার ভ্যান নামে ‘ডোর টু ডোর শপের’ ব্যবস্থা করেন। যে কেউ ফোন করলেই স্ব-স্ব ঠিকানায় পুলিশের গাড়ি নানা ধরণের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হাজির হচ্ছে। এ সার্ভিসটি এখনো চালু রয়েছে।
সিএমপি কমিশনার নিজ উদ্যোগে বিআইটিআইডিতে কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে মারসা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের সহযোগিতায় চালু করে ফ্রি বাস সার্ভিস।
এছাড়াও চালু করা হয়েছে হটলাইন, যার মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী হয়রানির শিকার হলে হটলাইনে ফোন করলেই পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা।
ভাইরাসের বিস্তার রোধে মার্চ মাস থেকেই সিএমপির উদ্যোগে নিজস্ব ওয়াটার ক্যানন ভেহিক্যালের মাধ্যমে পুলিশ লাইন্সসহ মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় জীবাণুনাশক পানি ছিঁটানো হয়।
রমজান মাসজুড়ে করোনার কারণে অসহায় ও নিঃস্ব হওয়া বিভিন্ন গার্মেন্টস শ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী এবং পথচারীদের সিএমপির বিভিন্ন থানার উদ্যোগে ও নিজস্ব অর্থায়নে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
করোনা সংক্রান্তে যেকোনো ধরনের গুজব ছড়ানো প্রতিরোধ, বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ, মজুদদারী ঠেকানোসহ জনগণের সাহায্য ও বিভিন্ন তথ্য প্রদানের লক্ষ্যে দুটি হটলাইন চালু করা হয়। হটলাইনগুলোতে ১৫ হাজার কল রিসিভের মাধ্যমে নগরবাসীকে সিএমপির পক্ষ থেকে করোনা সংক্রান্ত সেবা প্রদান করা হয়েছে।
করোনার বিস্তার রোধ ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে নগরবাসীকে অযাচিত আড্ডা এবং চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে চালু করা হয়েছে ড্রোন সাভিল্যান্স সিস্টেম।
এছাড়াও জটিল সময়ে জনগণ যেন সহজে ডাক্তারি সেবা পায়। সে জন্য ০১৮৭০-৭০০৭০০ নম্বর চালু করা হয়। এতে ফোন করলে একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা দেন। প্রতিদিন প্রায় ২শ’ থেকে ২৫০ জনকে এ কার্যক্রমের আওতায় সেবা দেওয়া হচ্ছে।
নগরজুড়ে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসচেতনা বৃদ্ধিতে সিএমপির নিজস্ব অর্থায়নে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার মাস্ক ও ১ হাজার স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। আগামীতেও এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে জানান সিএমপি।
সিএমপি কমিশনার মো. মাহবুবর রহমান জয়নিউজকে বলেন, আমরা প্রথমত মানুষ, দ্বিতীয়ত পুলিশ কর্মকর্তা। আমি এবং আমার সহকর্মীদের মাঝেও মানবিকতা কাজ করেছে বিধায় এই মুহূর্তে আমাদের নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও অনেক কাজ করতে পেরেছি।
এ সময় নগরবাসীর উদ্দেশে পুলিশ কমিশনার বলেন, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আপনারা ঘরের বাইরে বের হবেন না। একান্তই যদি বের হতে হয়, তখন মাস্ক, গ্লাভস পরিধান করবেন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। এতে করে আপনারা যেমন ভালো থাকবেন, তেমনি আমরাও ভালো থাকবো। ফলে আমাদের ডিউটিও কমে যাবে। ওই সময়ে আমরা আপনাদের নিরাপত্তার জন্য আরো বেশি নজর দিতে পারবো।
নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, অন্ততপক্ষে আমাদেরকে ভালো রাখাতে এবং নিজেকে করোনামুক্ত রাখতে আপনারা ঘরেই অবস্থান করুন।