বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিনের পর দিন বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। এই অবস্থায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভিন্ন ধরণের কৌশল নিয়েছে সরকার। এই কৌশলের তিনটি আঙ্গিক রয়েছে।
প্রথমত- সরকার মনে করছে, জীবন-জীবিকা পাশাপাশি চলবে। কোনো অবস্থাতেই অর্থনীতিকে অচল করে দেওয়া যাবে না। এই কারণে ঢাকাসহ গোটা দেশ লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনাগ্রহ সরকারের। বরং যে এলাকাগুলো বেশি সংক্রমিত, সেই এলাকাগুলোতে ধাপে ধাপে লকডাউন করার পক্ষে সরকার।
দ্বিতীয়ত- সরকার মনে করছে, করোনা সঙ্কটের চেয়েও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে অর্থনৈতিক সংকট। তাই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলাকে প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার। যার ফলে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত- করোনা সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রেও সরকার ভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে গত ২২ এবং ২৩ জুন দুই দফায় দেশের নয়টি জেলাকে লকডাউন করেছে। এই লকডাউনগুলো করা হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু অংশে। এই নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে যে, সরকার হঠাৎ করে এই সমস্ত এলাকাগুলোকে কেন লকডাউন করেছে? ঢাকাকে লকডাউন করার দরকার সবার আগে, তবে কেন অন্যান্য স্থানগুলোতে লকডাউন করা হচ্ছে?
এই ব্যাপারে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে সরকার একটি ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। সরকার চাইছে, ঢাকার বাইরের যে সংক্রমণ, সেই সংক্রমণগুলো আগে ঠেকাতে এবং ধাপে ধাপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের বাইরে সব এলাকাগুলোকে করোনা সংক্রমণমুক্ত করতে। ঢাকার বাইরে এই সমস্ত এলাকায় যদি আরও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে তাহলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এই সমস্ত স্থানে পর্যাপ্ত আইসিইউ-অক্সিজেন সাপোর্ট নেই। এই কারণে সরকার ঐ সমস্ত এলাকাগুলোতে লকডাউন করে সংক্রমণ সীমিত করতে চাইছে।
এই কৌশলের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, ওই এলাকাগুলো যদি সংক্রমণমুক্ত হয় তাহলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো অতিসংক্রমিত এলাকাগুলোকে দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে। সেই চিহ্নিত এলাকাগুলোকে লকডাউনের আওতায় আনা যাবে। তখন চাইলে পুরো ঢাকা বা চট্টগ্রামকে লকডাউন করতে পারবে। তবে এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সরকার মনে করছে, আগামী ৪০ দিনের মধ্যেই আবার ঈদের ছুটি শুরু হচ্ছে। কোরবানির ঈদের ছুটিটা সাধারণত দীর্ঘ হয়। এই সময় পর্যন্ত যদি করোনা সংক্রমণ থাকে, তাহলে সেই সময় বড় ধরণের লকডাউনের চিন্তা করা যাবে এবং তখন সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে।
তবে তার আগে যদি ঢাকার বাইরের সংক্রমণ বন্ধ করে দেওয়া যায় এবং ঢাকাকে অন্যান্য জেলাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায়, তাহলে ঢাকায় যে এলাকাগুলো অতি সংক্রমিত, সেই এলাকাগুলোকে পূর্ব রাজাবাজারের মতো লকডাউন করে সেখানে সংক্রমিতদের চিহ্নিত করে সংক্রমণ কমানোর চেষ্টা করা হবে।
সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো, করোনা রোগীদের চিকিৎসার অভাব যেন না হয়। ঢাকায় বেশি লোক আক্রান্ত হলেও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা যাবে, হাসপাতালের ব্যবস্থা করা যাবে। ইতোমধ্যে ঢাকার বহু মানুষ বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়ে উঠছে, তাই হাসপাতালের উপর এখন যে চাপ আছে তা আর বাড়বে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ জন্য ঢাকার বাইরে যেন চিকিৎসা সঙ্কট তৈরি না হয়, চাপ না বাড়ে সেজন্য ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোকে আস্তে আস্তে সংক্রমণমুক্ত করার প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছে এবং ধাপে ধাপে ঢাকার সংক্রমণ রোধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো, আমাদের অর্থনীতির মূল লাইফলাইন হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকাগুলো। সেজন্য সরকার লাইফলাইনগুলোকে বন্ধ করার পক্ষে না। এছাড়া এখন অর্থবছরের শেষ সময়, এই সময়ে ঢাকা বা চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণভাবে লকডাউন করে দিলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সেজন্য সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে সরকার জীবন-জীবিকা একসঙ্গে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।