প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। এরপর ৮১তম দিনে অর্থাৎ ১০ জুন মৃত্যুতে হাজারের ঘরে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। আর দ্বিতীয় হাজারের পথে প্রবেশ করতে সময় লেগেছে মাত্র ২৪ দিন।
শনিবার (৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, করোনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন এক হাজার ৯৯৭ জন। প্রতিদিনের গড় মৃত্যুর তথ্য বলছে ৫ জুলাই দুই হাজার অতিক্রম করবে মৃতের সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় আক্রান্ত বেশি তাই মৃত্যুও বেশি। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির প্রথম দিকে বাসায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি ছিল, যেটা অন্য দেশ থেকে ভিন্ন চিত্র। তবে বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, বেশিরভাগ মৃত্যুই হচ্ছে হাসপাতালে। তাদের মতে, হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হলে মৃত্যুর হার আরও কমানো সম্ভব।
মৃত্যু পরিস্থিতি
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) দেওয়া তথ্য মতে, করোনায় দেশে প্রথম মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি ছিলেন ৭০ বছর বয়সী। করোনার পাশপাশি তিনি অন্য রোগেও ভুগছিলেন। এরপর গত ২৫ মে অর্থাৎ প্রথম মৃত্যুর ৬৮ দিন পর ৫০০ অতিক্রম করে মৃত্যুর সংখ্যা। এরপর ১০ জুন ৮১ দিন পর এ সংখ্যা হাজারের ঘরে প্রবেশ করে। ওইদিন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১২ জন। এর ১২ দিন পর ২২ জুন মৃতের সংখ্যা দেড় হাজার অতিক্রম করে। সেদিন পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫০২ জন। দেড় হাজার অতিক্রম করার ১২ দিন পর ৪ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ৯৯৭ জন।
দেশে মার্চ মাসে মোট মৃত্যু ছিল পাঁচ জন, এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে’তে ৪৮২ জন এবং জুনে এক হাজার ১৯৭ জন। আর জুলাইয়ের প্রথম ৪ দিনে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫০ জন। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশই জুন মাসে।
আইইডিসিআরের তথ্য মতে, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৬০ ঊর্ধ্ব ৪৩ দশমিক ৫২ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ৭ দশমিক ৪১, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ১০ বছরের নিচে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ।
এছাড়া, করোনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে এক হাজার ৪১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫২১ জন, রাজশাহী বিভাগে ১০১ জন, খুলনায় ৮২ জন, বরিশালে ৬৭ জন, সিলেটে ৮৪ জন, রংপুরে ৫৩ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।
করোনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫৮৭ জন পুরুষ (শতকরা ৭৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ) এবং ৪১০ জন নারীর (শতকরা ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ) মৃত্যু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট এবং জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অন্যদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মৃত্যু পরিস্থিতি তুলনা করা বেশ কঠিন। কারণ একেক দেশের পরিস্থিতি একেক রকম। আমাদের মৃত্যুহার আরও কমানো যেতো, যদি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতো। ব্যবস্থাপনার ঘাটতির জন্য এই মৃত্যুহার। গত মাসে আরও হাইফ্লো ন্যাজেল ক্যানোলা আসার কথা ছিল। সেগুলোর ব্যবস্থা হলে কিন্তু মৃত্যুহার আরেকটু কমে যাবে।
আইইডিসিআরের পরিচালক এবং জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমাদের এখনও সব বিশ্লেষণ শেষ হয়নি। কিন্তু অন্যান্য দেশের থেকে আমাদের অনেক বেশি বয়স্ক ব্যক্তি মারা যাচ্ছেন। আমাদের দেশে বয়স্ক জনসংখ্যা কিন্তু কম। অন্যান্য দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী বেশি। আমাদের দেশে ৬০-৬৫ বছরের ঊর্ধ্বের বয়সীদের মৃত্যুহার বেশি। আমাদের আক্রান্তের মধ্যে ২১ থেক ৪০ বছরের সংখ্যা বেশি। মৃত্যু কিন্তু আবার ষাটোর্ধ্বদের বেশি হচ্ছে। এসব মিলিয়ে বয়স্কদের মৃত্যু এবং যাদের কোমরবিডিটি আছে, তাদের মৃত্যু বেশি দেখতে পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া আরেকটি প্যাটার্ন আমরা দেখেছি, অন্যান্য দেশে হয়তো এই তথ্যটি নেই অথবা তাদের ক্ষেত্রে হয়তো ঘটেনি। আমাদের কিন্তু বাসায় অনেকে মারা যাচ্ছিলো, হাসপাতালে পরে আসছিলো। ঢাকায় এখন এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, এখানে এখন মোটামুটি যারাই মারা যাচ্ছেন বেশিরভাগই হাসপাতালে। কিন্তু ঢাকার বাইরে কিন্তু এখনও বাড়িতে মারা যাওয়ার ঘটনা আছে। ঢাকায় আক্রান্ত হার বেশি বলেই মৃত্যুহারটাও বেশি বলে মন্তব্য করেন তিনি।