২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর টানা তৃতীয়বারের মতো ও দেশের ইতিহাসে চতুর্থবার সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সরকারের তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা ও তথ্যপ্রবাহের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ড. হাছান মাহমুদ।
মন্ত্রী পরিষদ গঠনের পর ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যম জয়নিউজে ‘তথ্যপুত্র এখন তথ্য মন্ত্রণালয়ে’ শিরোনামে একটি বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল তৃণমূল থেকে কিভাবে এ পর্যন্ত উঠে এসেছেন ড. হাছান মাহমুদ। এছাড়া ওই বিশেষ সম্পাদকীয়তে সাংবাদিকদের বিভিন্ন দাবির প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়েছিল।
চট্টগ্রামের সন্তান ও সফল এই নেতা তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় সে সময়ে আমরা খুব খুশি হয়েছি। আরো খুশি হয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে মিডিয়াবান্ধব একজনকে তথ্যমন্ত্রী করায়। আর গণমাধ্যমের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আমি সম্মানিত হয়েছি।
যে আশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে তথ্যমন্ত্রী করেছিলেন, আমি গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মনে করি তথ্যমন্ত্রী সেই আশা পূরণ করেছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দলীয় কর্মকাণ্ডে সর্বোচ্চ নিবেদিত থেকে মন জয় করেছেন দলীয় প্রধানের। এর পুরস্কার হিসেবে আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিলে দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক’ হিসেবে নির্বাচিত হন ড. হাছান মাহমুদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে যে কয়জন পরিচিত তার মধ্যে ড. হাছান মাহমুদ অন্যতম।
করোনা পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয়, দলীয় কর্মকাণ্ড, নির্বাচনি এলাকায় সময় দেওয়া এবং চট্টগ্রামে সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয় করা- সব কাজই করেছেন তিনি। একমাত্র মন্ত্রী হিসেবে তিনি করোনাকালে প্রতিদিন অফিস করছেন আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে চট্টগ্রামে নিজ নির্বাচনি এলাকায় ছুটে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কাজ পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি পালন করে চলছেন করোনা পরিস্থিতি বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগ সমন্বয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব। ঢাকায় থাকলে নিয়মিত আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে যাওয়া তার রুটিন কাজ।
তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গত দেড় বছরে ড. হাছান মাহমুদের পাঁচটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ তাকে সাহসী হিসেবে আলোচনায় এনেছে। আমরা সেই বিষয়ে এখন কিছু আলোচনা করবো।
এক– আইন অনুযায়ী দেশে সম্প্রচারিত কোনো বিদেশি টিভি চ্যানেলে অনুমতি ছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ থাকলেও এ বিষয়টি পূর্বে আমলে নেওয়া হয়নি, যদিও দেশীয় পণ্য ও তার বাজারের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবার পর থেকেই ড. হাছান মাহমুদ দেশের স্বার্থে এ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগে দৃঢ়তার নীতি গ্রহণ করেন। এতোদিন ধরে যে কাজ প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হয়, ক্যাবল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিন্তু বলা যায়, মন্ত্রীর একক দৃঢ়তার কারণেই আইনের পথে হাঁটতে শুরু করে সবাই। যদিও বিষয়টি সহজ নয়, প্রয়োজন ক্যাবল নেটওয়ার্কের পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপায়ন। সেজন্যও বাস্তব সময়সীমা বাঁধতে চান তথ্যমন্ত্রী।
দুই– পূর্বে ক্যাবল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের বারবার বলা সত্ত্বেও টিভি চ্যানেলগুলোর ক্রম সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সাজানো থাকতো না। নেটওয়ার্ক অপারেটররা তাদের মর্জিমাফিক চ্যানেলগুলোর ক্রম ঠিক করতো এবং সামনের দিকে স্থান পাবার জন্য এমনকি কোনো এলাকায় টিভি চ্যানেল যাতে দেখা যায় সেজন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতার নানা অভিযোগের কমতি ছিল না। নতুন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান প্রত্যেক জেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এটিকে নিয়মের মধ্যে এনেছেন। এখন ক্যাবল নেটওয়ার্কে দেশের টিভি চ্যানেল সবার আগে এবং সেগুলো তাদের সম্প্রচারের তারিখ অনুযায়ী পরপর সাজানোর ব্যবস্থা হয়েছে।
তিন– অবৈধ ডিশ টিভির দৌরাত্ম্যে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নানা উপায়ে চলে যেতো। বিদেশি কিছু কোম্পানী আইন প্রয়োগের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। তথ্যমন্ত্রী একটি আগাম নোটিশ দিলেন এবং ২০২০ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে এ অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটালেন। দেশ প্রতিবছর অন্তত হাজার কোটি টাকা লোকসান থেকে বাঁচলো।
চার– তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের সঙ্গে যেসকল অনাকাঙ্খিত চ্যালেঞ্জ সমাজে উদয় হয় তাদের মধ্যে সাম্প্রতিকতম চ্যালেঞ্জটি ছিল ইন্টারনেটে ওয়েবসিরিজের নামে সেন্সরবিহীন অশালীন দৃশ্য ও কাহিনীর সম্প্রচার। ইন্টারনেটে সেই প্লাটফরমগুলো আবার দেশের বড় বড় মোবাইল ফোন কোম্পানী।
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট, ‘বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে দেশের সংষ্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কোনো সম্প্রচার শুধু আইনের চোখেই অপরাধ নয়, দেশ ও জাতির প্রতিও প্রতিও অবজ্ঞা প্রদর্শন।’
পাঁচ– ক্যাবল নেটওয়ার্কে একসময় চ্যানেল সামনের দিকে রাখার জন্য যে অসুস্থ ও ক্ষতিকর প্রতিযোগিতা ছিল, কোন টেলিভিশন বেশি মানুষ দেখে সেটা নির্ধারণকারী টিআরপি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে একই ধরণের অসুস্থতা চলে এলেও বিষয়টিতে নজরদারির অভাব ছিল সুস্পষ্ট। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান এ বিষয়েও দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার ভাষায় তার লক্ষ্য হচ্ছে, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত করা এবং নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার মাধ্যমে যাতে সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রতিফলিত হয়, সেজন্য রাষ্ট্র অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ জরিপ পরিচালনা।
এ বিশেষ পাঁচ পদক্ষেপ ছাড়াও দেশের সকল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া দেখভাল করার কাজ সরকারি আওতামুক্ত করে স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সম্প্রচার আইন প্রণয়নের কাজ চলছে, এছাড়া চলছে গণমাধ্যমকর্মী (চাকুরি শর্তাবলী) আইন প্রণয়নের কাজও। তথ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে তাগাদাও দিয়েছেন।
ড. হাছান মাহমুদ তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশন গত ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে দুরদর্শন ফ্রি ডিশের মাধ্যমে সমগ্র ভারতে সম্প্রচার চালু হয়েছে। পারস্পরিক এ সহযোগিতা বিস্তৃত হয়েছে বেতারের ক্ষেত্রেও। এ বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে প্রথমবারের মতো সমগ্র ভারতে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান দৈনিক ৪ ঘণ্টা সম্প্রচার ও বাংলাদেশ বেতারে আকাশবাণীর অনুষ্ঠানের অনুরূপ সম্প্রচার চালু হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য পৃথিবীর কোনো দেশই প্রস্তুত ছিল না। বাংলাদেশ একটি খেটেখাওয়া মানুষের দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করছেন ও অপরদিকে স্বাস্থ্যসহ সকল খাতে সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামোর সর্বোচ্চ উপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলেই এখনো বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুহার বিশ্বের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। জীবন ও জীবিকা রক্ষার এই অনন্য প্রয়াসের পথ ধরে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমরা নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবো নতুন সূর্যের দিনে।
১৯৬৩ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. হাছান মাহমুদ অনেক বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন।
চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাশ করে তৎকালীন ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে মহসিন কলেজ) ভর্তি হয়ে ওতপ্রোতভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আমাদের প্রিয় হাছান ভাই। নির্বাচিত হন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে। এরপর চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দেন হাছান মাহমুদ।
তিনি ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন কিছুদিন। সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের।
উত্তাল ছাত্ররাজনীতির পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য একসময় ইউরোপ চলে যান। ভর্তি হন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ব্রিজ ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসে। পাশাপাশি বেলজিয়াম আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। নির্বাচিত হন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ব্রিজ ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক স্টুডেন্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পড়াশোনা শেষে বেলজিয়ামের লিমবার্গ ইউনিভার্সিটি সেন্টাম-এর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ড. হাছান মাহমুদ। কিন্তু চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এই সন্তানকে বিদেশের বিত্ত-বৈভব বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে বিদেশে শিক্ষকতা ও নিরাপদ জীবনের চাকরি ফেলে দেশে ফিরে আসেন। এসেই জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির (২০০১ সাল) সঙ্গে যুক্ত হন।
এরপর যোগ দেন সভানেত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে। কিছুদিনের মাথায় আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সে দায়িত্ব পালন করেন ড. হাছান মাহমুদ। সভানেত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন ড. হাছান মাহমুদ। এজন্য প্রথমবার তাক লাগিয়ে দিয়ে মন্ত্রিত্বের মর্যাদা পান তিনি। ২০১৪ সালেও এমপি পদে বিজয়ী হন তিনি। তাঁর নিজের একাডেমিক দক্ষতা পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলের প্রতিকূল সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় বারবার প্রশংসিত হয়েছেন হাছান মাহমুদ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে হ্যাট্রিক বিজয় লাভ করেন তিনি। এবারের নির্বাচনে ২ লাখ ১৭ হাজার ১৫৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন তিনি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী পান মাত্র ৬ হাজার ৬৫ ভোট।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রথম ৬ মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পর বাকি সময়টুকু সাফল্যের সঙ্গে পরিবেশ ও বন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে সফলতার সঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের এই কৃতি সন্তান।