ভারতের সংবিধান থেকে এক বছর আগেই বাতিল করা হয়েছিল ৩৭০ ধারা। তবে ৩৭০ ধারা বাতিল করা নিয়ে মতভেদ ছিল। গণতন্ত্রে এটা স্বাভাবিক। এমনকি ৩৭০ ধারার ভবিষ্যৎ নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর গণপরিষদও কোনও সঠিক দিশা দিয়ে যেতে পারেনি।
তাই দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে উপত্যকার মানুষকে উদ্ধার করে দেশের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে স্থানীয় দের সামিল করতে জরুরি ছিল ধারাটির বাতিল। এই মতেরই সমর্থক বেশি। পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, ৩৭০ ধারা রদের বিরোধিতা করেনি কংগ্রেস। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংও নীতিগত ভাবে মেনে নিয়েছেন ৩৭০ প্রত্যাহার।
জম্মু ও কাশ্মীরের এই বিশেষ রক্ষা কবচ নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। ৩৭০ ধারা নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যেও এবিষয়ে চূড়ান্ত মতভেদ ছিল। গণপরিষদের সদস্যরা সুস্পষ্ট কোনও ধারনাই দিয়ে পেতে পারেননি। তারা ৩৭০ ধারাকে চিরস্থায়ী করতেও বলেননি। আবার তুলে দেওয়ার পক্ষেও মত প্রকাশ করেনি। আসলে সদস্যদের মধ্যেও ছিল এ নিয়ে দোটানা।
৩৭০ ধারার অভিমুখ নিয়েও সংশয় ছিল খোদ গণ-পরিষদের সদস্যদের মধ্যেও। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রাদেশিক আইনসভার পক্ষে। তাদের মতে, প্রাদেশিক ক্ষমতার বিচ্যুতি ঘটলে কেন্দ্রে হাতে চলে যাবে সব ক্ষমতা ও অধিকার।
অন্যপক্ষ আবার ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন গণ-পরিষদে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে দলের তখনকার সভাপতি আচার্য জেবি কৃপালনিও রাজ্যগুলির যথেষ্ট স্বশাসনের পক্ষে তার বক্তব্য পেশ করেন।
তার মতে— ক্ষমতা বেশি কেন্দ্রীভূত হলে প্রাদেশিক স্বাধীনতা খর্ব হবে। দেশভাগের পরও বিতর্ক চলতে থাকে। উঠে আসে নতুন প্রশ্ন। দেশের অখণ্ডতার বিষয়টিও চলে আসে সামনে। ভারতে বহুত্ববোধকে সম্মান জানিয়ে দেশের অখণ্ডতার কথা মাথায় রেখে রচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ক্ষমতার বিন্যাস। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকেও দেওয়া হয় গুরুত্ব।
স্বাধীনতার পর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়েই ছিল। অঙ্গরাজ্য হলেও তারা অনেকটাই নিজেদের খেয়াল মতোই চলতো। তাদের জন্য ছিল আলাদা সংবিধান! ৩৭০ ধারা বলে তারা ভারতের সংবিধানের অনেক ধারাকে মানতে বাধ্য ছিলেন না। এক দেশে থেকেও তারা পেতেন বাড়তি স্বশাসন। সেখানকার মানুষদের আবেগের কাছে রক্ষাকবচ ছিল ৩৭০ ধারা। তাই ৩৭০ ধারা নিয়ে তারা ছিলেন খুবই স্পর্শকাতর। মুষ্ঠিতয়েক মানুষ এই ৩৭০ ধারার সুযোগ নিয়েই নিজেদের শাসন ও শোষণ কায়েম করছিলেন উপত্যকায়।
এ কারণেই জরুরি হয়ে পড়েছিল স্থানীয় মানুষদের উন্নয়ন আর নিরাপত্তার স্বার্থেই ৩৭০ ধারা রদ। আগেও বহুবার পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে নির্মূল করা হয়নি সমস্যার। ৩৭০ ধারা নিয়ে অন্তত ৪০ বার সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরে দফা দফায় কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তন করেছেন সরকারি নির্দেশিকা। গত বছর ৩৭০ ধারা বাতিলের আগেই ৯৭টির মধ্যে ৯৪টি বিষয় আগেই পরিবর্তিত হয়। তবে আর পরিবর্তন নয়। গত বছর ৫ আগস্ট ৩৭০-কে বাতিল করারই সিদ্ধান্ত নিলো ভারত সরকার।
সিদ্ধান্তের সমর্থনে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পেশের সময় কড়া সমালোচনা করেছিলেন ৩৭০ ধারার। তার মতে, জম্মু ও কাশ্মীরে দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর বিচ্ছিন্নতাবাদের ৩৭০-ই মূল কারণ। ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত রাজ্যে সন্ত্রাস দমনে সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষ পাবেন সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করতে। তারাও পাবেন দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো চাকরি বা শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা। সকলের জন্য শিক্ষা বা তথ্য জানা অধিকার গোটা দেশে চালু থাকলেও কাশ্মীরের মানুষ ছিলেন এসবের থেকে বঞ্চিত।
আসলে ৩৭০ ধারার আড়ালে উপত্যকার তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, অনগ্রসহ শ্রেণির মানুষদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। জাতীয়-স্তরের একাধিক প্রকল্পের সুবিধার কথা এতকাল জানতেই পারতেন না তারা। ভারতের নাগরিক হয়েও সুবিধা ভোগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল তাদের। ৩৭০ ধারা লোপ তাঁদের সেই বাধা দূর করলো।
২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করা হলেও কাশ্মীরের হিন্দু মহিলারা তার সুবিধা এতকাল পাননি। এখন তারা পুরুষদের সমান উত্তরাধিকারের অধিকারী মহিলারাও। গোটা দেশের মতো কাশ্মীরেও মহিলারা ৩৭০ ধারা রদের পর পাচ্ছেন সম্পত্তির অধিকার। জম্মু ও কাশ্মীরের সম্পত্তি হস্তান্তরের আইনও বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে ভারতীয় নাগরিকরা এখন কাশ্মীরে সম্পত্তি কেনার অধিকার পেলেন। আর কাশ্মীরিরাও পেলেন সম্পত্তি হস্তান্তরে স্বাধীনতা।
৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে সংবিধান মেনেই। কোথাও কোনও আইনি জটিলতা নেই। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নিয়েই বাতিল হয়েছে ৩৭০ ধারা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ সি কাশ্যপ মনে করেন, আইনগত দিক থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার অবকাশই নেই। সরকার পুরো প্রক্রিয়াটাই দেশের সংবিধান মেনেই করেছে। ৩৭০ ধারা বাতিল প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও তেমন কোনও প্রশ্ন আচে বলে মনে হয় না।
বিবিসি জানিয়েছে, সংসদে বিজেপির চিরাচরিত বিরোধী সাংসদেরাও অনেকে ৩৭০ ধারা বাতিলকে সমর্থন জানিয়েছে। কংগ্রেসেরও বহু নেতা ৩৭০ ধারা বাতিলকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করেছে বলেও উল্লেখ করেছে বিবিসি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা ড. মনমোহন সিং নিজেই বলেছিলেন, নীতিগতভাবে তারা ৩৭০ ধারা রদের পক্ষে।
এক বছর আগের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন পুলিশ প্রধান ড. অশোক ভান। তার মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে মানুষের আস্থা বাড়তে শুরু করেছে ভারত সরকারের ওপর। দূর হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা। গণতান্ত্রিক চেতনারও উপত্যকায় বিকাশ ঘটছে বলে তিনি মনে করেন। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা প্রয়োজন ছিল।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত এখন স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস অর্জন। শুরু করা উচিত মূল ধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও। তাহলেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়ে কাশ্মীর আবার ফিরে আসবে দেশের মূলস্রোতে।
৩৭০ ধারা বাতিলের প্রায় ১ বছর পরেও অনেকে সমালোচনা করছেন সরকারের। পেছনে পাকিস্তানি মদতও রয়েছে। তবে উপত্যকার মানুষ বুঝতে পারছে, তাদের সামনে রয়েছে সুদিনের হাতছানি। সরকার স্বল্প ও দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার মাধ্যমে উপত্যকার উন্নয়নে মন দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি দুর্বলতা মুছে ফেলে সন্ত্রাসকে আলবিদা জানানোর এসেছে সময়। উন্নয়নের স্রোতে গা ভাসাতে চাইছেন তারা। বুঝেছেন, দিল্লির কাছ থেকে সবধরনের সুবিধা আদায়ের স্বার্থেই মুখ ফেরাতে হবে পাকিস্তানি প্ররোচনা থেকে।
সন্ত্রাসীদের মদত ভুলে তারা চাইছেন বিভ্রান্ত যুবকেরা ফিরিয়ে এনে দিল্লির আস্থা অর্জনে। নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা বদলে মন-প্রাণ দিয়ে ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টাও চলছে। আসলে উপত্যকার মানুষদের আর্থিক বিকাশেরও বিরাট সুযোগ এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে নেমে পড়েছে রাজ্য পুনর্গঠনে।
বর্তমানে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা না থাকলেও ভারত সরকার কথা দিয়েছে ফের ফিরিয়ে দেওয়া হবে সেই মর্যাদাও। তার আগে উন্নয়ন, শুধু উন্নয়নকেই পাখির চোখ করতে চায় দিল্লি। সন্ত্রাস-ক্লান্ত কাশ্মীর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্যেও অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র আর সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘরকে চিরতরে বিলুপ্ত করেই কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন চাইছে ভারত।
৩৭০ ধারা বাতিল জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য উন্নয়নের হাত ধরে নতুন প্রভাত এনে দেবে। বঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষরা পাবেন সবধরনের সুযোগ। দেশের সুনাগরিকের মর্যাদা ও মৌলিক অধিকার। সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আশার আলো সঞ্চার করেছে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে।
দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে নয়, সমস্ত রাজ্যগুলির সঙ্গে একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই উপত্যকায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর সরকার। ৩৭০ ধারা রদ করে উন্নয়নমূলক একগুচ্ছ কর্মযজ্ঞ শুরু করে এক বছরের মধ্যেই সেই প্রত্যাশার পদচিহ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে ভারত সরকার। উপত্যকার সাধারণ মানুষও একই কথা বলছেন।