আশফাক (ছদ্মনাম) ২০১৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে মাস্টার্স শেষ করেন। দারুণ আবৃত্তি করেন, যুক্ত আছেন একটি প্রথম সারির নাটকের দলের সাথেও। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, সাংষ্কৃতিক অঙ্গণের এই পরিচিত মানুষটিকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করেন, ভাই, কি করেন আপনি? তখন আশফাক থমকে যান। বলতে পারেন না (তবু বলতে হয়), আমি গার্ড, মাস্টার্স পাস সিকিউরিটি গার্ড!
কোন পেশাই ছোট নয়। কাজতো কাজই। কিন্তু দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী মানুষটি তার দেড় যুগের শিক্ষার, সাধনার আরেকটু সম্মানজনক প্রতিদান কী পেতে পারতেন না? পেতে পারেন না ভালো বেতনের একটা ভালো চাকরি, একটি ভালো অংকের সম্মানি?
কিন্তু তিনি তা পাননি। আশফাকের প্রকৃত নামটা আমরা এখানে নিচ্ছি না। কিন্তু তার কষ্টগুলো, প্রতিকূলতা আর জীবনসংগ্রামের গল্পটা, আসুন তার জবানিতেই শুনি।
চট্টগ্রাম বন্দরে সিকিউরিটি গার্ড পদে চাকরি করেন আশফাক। চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার এনায়েতপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। চট্টগ্রামের একটি আবৃত্তি দলের একজন নিয়মিত সদস্য। ২০০৬ সাল থেকে যুক্ত নগরের একটি থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে। একসময় নিয়মিত করতেন মঞ্চ নাটক।
‘একসময় স্বপ্ন দেখতাম গার্মেন্টস সেক্টরে বড় বড় বায়ারদের সঙ্গে কাজ করবো। তবে ধৈর্য না থাকার কারণে ওই সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব হয়নি।’ আক্ষেপ করে বললেন আশফাক। শোনালেন বন্দরের চাকরিতে যোগ দেয়ার গল্প, ‘প্রত্যেকটা মানুষের স্বপ্ন থাকে সরকারি চাকরি করার। সরকারি চাকরির নির্ধারিত বয়সসীমা পার হতে আমার তখন আর বেশিদিন বাকি ছিল না। মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর শেষ সুযোগ হিসেবে তাই চট্টগ্রাম বন্দরের এই পদে আবেদন করি। একটা চিন্তা ছিল যে এখানে যোগদানের পর যদি কোন সুযোগ আসে সেটা কাজে লাগাতে পারবো। তাছাড়া সরকারি চাকরির একটা নিশ্চয়তা আছে, বেতনটা সঠিক সময়ে পাবো, চাকরি থেকে অবসরে গেলে পেনশন পাবো, পারিবারিকভাবে একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে। সরকারি চাকরি পেতে যেভাবে কষ্ট হয়, তেমনি চাকরি যাওয়াও সহজ নয়। এসব ধারণা থেকেই মূলত এই চাকরিতে আসা।’
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে কষ্টের অনুভূতিগুলো আশফাক বললেন এভাবে, ‘আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় এই পোস্টটা ছোট হলেও আমি কোন কাজকেই ছোট মনে করি না। কিন্তু সিনিয়রদের কাছ থেকে সমর্থন বা উৎসাহ পাওয়া দূরে থাক, আমার পদটা ছোট হওয়ার কারণে ছোট কোন ভুল করলেও যখন গালি শুনতে হয়, কখনও রীতিমতো লাঞ্ছিত, অপদস্ত হতে হয়। তখন নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে যাই, খুব কষ্ট হয়।’
এটা শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়। সরকারি চাকরির প্রতিটি সেক্টরেই এখন এই চিত্র খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫০টি পদ খালি হলে সেখানে পাঁচ থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত আবেদন পড়তে দেখা যায়! নানা সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক নিরাপত্তার কারণেই মূলত দেশের বেকার যুব সমাজের এই সরকারি চাকরিমুখিতা। বিশেষজ্ঞরা তাই বেসরকারি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ এবং দেশের বেকার যুবক-যুবতীদের আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করার ওপর জোর দিচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
চট্টগ্রাম বন্দরের আরেকজন সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা হয় আমাদের। নগরের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ করেছেন তুষার (ছদ্মনাম)। বাড়ি বাঁশখালী থানার জলদী ইউনিয়নে। যুক্ত আছেন নগরের অপর একটি প্রতিষ্ঠিত নাট্যগোষ্ঠীর সাথে। স্বপ্ন ছিল মিডিয়াতে কাজ করার। কিন্তু জীবন যুদ্ধে নেমে মেনে নিতে হয়েছে কঠিন বাস্তবকে। বাবার পথ ধরে চাকরি নিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সিকিউরিটি গার্ড পদে।
তুষারের বক্তব্য, ‘বাবার চিন্তা ছিল ছেলেকে যদি একটি সরকারি চাকরি ‘লাগিয়ে’ দিতে পারি তাহলে আর কিছু না হোক অন্তত চারটা ডাল-ভাত খেয়ে হলেও জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাবার চাওয়ার কারণে এখানে আসা। তাছাড়া ভালো চাকরির সংকটতো আছেই। সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু যখন কেউ সিকিউরিটি গার্ড বলে হেয় করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তখন খুব খারাপ লাগে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ শিক্ষিত জনশক্তির জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে তাদের কারিগরী শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প খাতেও একটি বড় সংখ্যক বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হতে পারে। তবে সবার আগে ‘যেকোন মূল্যে যেকোন সরকারি চাকরি পেতেই হবে’ এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
জয়নিউজ/জুলফিকার