হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও তাঁদের সহযোগীদের গ্রেফতারসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের ৬৫টি সংগঠন। মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে সংগঠনগুলো একযোগে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে এ দাবি জানিয়েছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে বেলা আড়াইটার দিকে মানববন্ধন শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এটি মৎস্য ভবন থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, শাহবাগ মোড় ঘুরে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর বেলা ৩টার দিকে শুরু হয় সমাবেশ। এতে বক্তারা বলেন, ভাস্কর্য একটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ। সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর সব মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘একটি গোষ্ঠী’ ভাস্কর্যবিরোধী ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিচ্ছে।
‘এই গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এটি চরম ধৃষ্টতা ও জাতির পিতা, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা। এই গোষ্ঠীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। তারপরও তারা যদি ধৃষ্টতা দেখায়, তবে তাদের এর পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
মানববন্ধন ও সমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান। এতে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত হেফাজত-খেলাফতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক নেতারা ওয়াজের নামে সমাবেশ করে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে তাঁরা পাকিস্তান ও তালেবানি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতায় সরব রয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা জুনাইদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক। তাই আজকের কর্মসূচিরও মূল দাবি ছিল এই দুজনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা।
ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অবিলম্বে বাংলাদেশে জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ওয়াজ মাহফিলের নামে ভিন্নমত, নারী এবং ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, জাতির পিতার ভাস্কর্য সম্পর্কে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তার প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ জানানোর কোনো ভাষা খোঁজে পাচ্ছি না। তারাই এ কাজ করছে যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বলেছে “বাংলা” ইসলামের ভাষা নয়, ১৯৫৪-এর নির্বাচনের সময় বলেছে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। তারাই ১৯৭০-এর নির্বাচনে ইসলামকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে ঠেকাতে চেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের ‘আস্ফালন’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, আস্ফালন বন্ধ করুন, না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ রাজপথেই এর জবাব দেবে, যার পরিণাম ভালো হবে না। আর ধৃষ্টতা দেখালে পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, তারাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখনো বেঁচে আছেন।
কর্মসূচিতে সংহতি জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও ভাস্কর্য আছে। ভাস্কর্য ও মূর্তির পার্থক্য বালকও বোঝে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবে কেউ ঠেকাতে পারবে না ঘোষণা দিয়ে মেয়র বলেন, ধর্ম ব্যবসায়ীরাই এর বিরোধিতা করছে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি।’
পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বারবার ষড়যন্ত্র করেছে, এখন আবার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ শিরীন আখতার বলেন, যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। এই ব্যবসায়ীদের বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে মারা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা এখনো জীবিত আছি। মৌলবাদী শক্তিকে যে করেই হোক প্রতিহত করতে হবে। বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, জাতির পিতাকে যারা অবমাননা করছে, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ, প্রজন্ম একাত্তরের সভাপতি আসিফ মুনীরসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দিনের কর্মসূচি শেষ হয়। তবে এমন প্রতিবাদী কর্মসূচি বিজয়ের মাসজুড়ে চলবে বলে আয়োজকেরা জানিয়েছেন।
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে— একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাসোসিয়েশন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, প্রজন্ম ’৭১, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, ইতিহাস সম্মিলনী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ।
বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), জাতীয় যুব জোট, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ সংহতি পরিষদ,।
বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ), বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম, গৌরব ’৭১, অপরাজেয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, কর্মজীবী নারী, জাতীয় নারী জোট, নারী মুক্তি সংসদ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ (বাংলাদেশ চ্যাপটার), জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চা, সেক্যুলার ইউনিটি বাংলাদেশ, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ঘাসফুল শিশু কিশোর সংগঠন, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ।