কলাবাগানে ধর্ষণ-হত্যার শিকার ছাত্রীর মা বলেছেন, ‘বলা হচ্ছে, দিহানের সঙ্গে মেয়ের রিলেশন ছিল, মানলাম। কিন্তু রিলেশন থাকলেই ধর্ষণ বা মেরে ফেলার অধিকার তো রাখে না।’
বুধবার (১৩ জানুয়ারি) নিজ বাসায় জাতীয় এক দৈনিকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে ধর্ষণের শিকার হয় ‘ও’ লেভেলে পড়ুয়া ছাত্রী। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মেয়েটি মারা যায় বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
এই মা বলেন, তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় একজন নয়, একাধিক মানুষ জড়িত ছিল। তিনি জড়িত সবার যথোপযুক্ত শাস্তি দাবি করেন। মেয়েকে হারিয়ে তিনি বলেন, মেয়ে ২০ মিনিটের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু সে আর ফিরে এল না।
মারা যাওয়া মেয়েটির রুমে বসেই কথা বলেন মা। মেয়ের রুম সাদা ও বাদামি রঙে ছিমছাম করে সাজানো। পড়ার টেবিলে পড়ে আছে পারিবারিক একটি অ্যালবাম। মেয়ের বইসহ অন্যান্য জিনিস সাজিয়ে রাখা আছে। মা জানালেন, মেয়ে হালকা রং পছন্দ করত। মেয়ের পছন্দেই ঘরের পর্দা কেনা হয়েছিল।
এই মা বলেন, মেয়ে স্বেচ্ছায় সেখানে গেছে, তা বিশ্বাস করি না। অচেতন করে বা যেভাবেই হোক, মেয়েকে নেওয়া হয়েছে। এটা পরিকল্পিত ছিল। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, হাসপাতালে তিনি চারজনকেই দেখেছেন। তাঁকে মেয়ের অসুস্থতার কথা বলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দিহান নামের ছেলেটি তাঁকে ফোন দিয়েছিল।
তিনি বললেন, দিহান আমার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে। পরে ওরা চারজন বসা ছিল সোফায়। এই চারজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। দিহান তো স্বীকারোক্তি দিয়েছে। অন্যরা জড়িত থাকলে তাদেরও বিচার চাই। ধর্ষণের সহযোগী হলে সে হিসেবেই শাস্তি পাবে। আর চারজনই ধর্ষণ করলে তাদের সেভাবেই বিচারে আনা হোক।
ও-লেভেলে পড়ুয়া মেয়েটির মা জানালেন, তিনি মামলার প্রধান আসামির কাছে হাসপাতালে জানতে চেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে মেয়ের কীভাবে দেখা হলো? তখন জানায়, ‘তারা চার বন্ধু আর আমার মেয়ে ছিল। বাসায় কেউ ছিল না। ফাঁকা ছিল। এমনি এমনি সেন্সলেস হয়ে গেল? এ প্রশ্ন করা হলে তখন আর কথা বলে না।’
মেয়েকে হাসপাতালে যে অবস্থায় দেখেছিলেন সে প্রসঙ্গে মা বললেন, ‘শুনলাম মেয়ের ব্লিডিং হচ্ছে, মারা গেছে। দেড় ঘণ্টা পর মেয়েকে দেখতে দিল। দেখলাম বেডে, যে কাপড় ছিল সবখানে রক্তে ভিজে গেছে। বিধ্বস্ত। মনে হলো ওর শরীরে রক্ত নাই। একবার তাকিয়ে আর মেয়ের দিকে তাকাতে পারিনি। ডাক্তার জানালেন, মৃত অবস্থায় পেয়েছেন, তার মানে বাসা থেকেই মেয়েকে মৃত এনেছে।’
মা বললেন, ‘হাসপাতালে আমার এক বান্ধবী ছিল। জরুরি বিভাগে বান্ধবী ওর ফোন দিয়ে মেয়ের ছবি তোলে। পিঠে এবং শরীরে দাগ আছে। ও যে টর্চার হয়েছে, তার প্রমাণ। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ময়নাতদন্তের পর প্রাথমিকভাবে যা জানিয়েছেন, তা তো সবাই জানেন। মেয়েকে বিকৃতভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান দাগের কথা অস্বীকার করলেও তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।’
এই মা জানালেন, মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর মতো ছিল। পড়ালেখার চাপ ছিল মেয়ের। খাওয়াদাওয়া কম করত। খেতে বললেই বলত, খেতে ইচ্ছে করছে না। তখন রেগে যাওয়ার ভাব করলে মেয়ে হেসে বলত, ‘রাগো রাগো, তুমি তো আমার বান্ধবী, রাগতে পারবে?’ মা বললেন, ‘ও সব কথা আমাকে বলত। রিলেশন যদি হয়ে থাকত, ও আমাকে না বলে থাকত না।’
এক মাস আগে খাবার টেবিলে গ্রামের বাড়িতে কবরস্থান মেরামতের আলোচনা হয়। তখন হুট করেই মেয়ে জানতে চায়, সে মারা গেলে তাকে কোথায় রাখবে? মা তখন হেসে বলেছিলেন, এসব কথা এখন কেন, যখন লাগবে দেখা যাবে।
মা মেয়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন,‘দুই মেয়ে একসঙ্গে ঘুমাত। প্রতি রাতেই দুই মেয়েকে দেখে যেতাম। গায়ে কম্বল আছে কি-না, দেখতাম। সকালে গাড়ি চলে আসায় তাড়াতাড়ি গাড়ি ধরার জন্য মেয়েদের গায়ে কম্বল টেনে চলে যাই। সকাল ১১টার দিকে মেয়ে ফোন দেয়, জানায়, কোচিংয়ে পেপার আনতে যাবে, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। একা যাচ্ছে বলে সাবধানে যেতে বলি। ২০ মিনিটের কথা বলে বের হয়েছিল, তারপর কীভাবে ওই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, তা জানি না।’
মা জানালেন, পুলিশ জানিয়েছে, প্রধান আসামির বাসার বিছানার চাদর, বালিশ, মেয়ের গায়ের কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল। পুরো রুম, সিঁড়িতেও নাকি রক্ত ছিল। তিনি বলেন, তাঁর মেয়েসহ সব ধর্ষণ মামলার আসামিদের কঠোর শাস্তি চাই। আর কোনো মেয়ের সঙ্গে যাতে এমন না হয়।