ঢাকা টেস্টে ২৩১ রানের লক্ষ্যে ২১৩ রানেই অলআউট বাংলাদেশ। টেস্ট হেরে গেল ১৭ রানে। চট্টগ্রামের পর মিরপুর— সিরিজের দুই টেস্টেই হেরে বাংলাদেশ হলো হোয়াইটওয়াশ। ঘরের মাটিতে যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হলো ৯ বছর পর। আগেরটিও ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই, তবে সেটি ছিল পূর্ণশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এবার মুমিনুলরা হোয়াইটওয়াশ হলেন আনকোরাদের নিয়ে গড়া এক ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে!
২৩১ রানের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের একের পর এক ব্যাটসম্যানের ওপর ভরসা স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। কিন্তু ভরসার দাম কেউই রাখতে পারেননি। তামিম হয়ে মুশফিক-মুমিনুল কিংবা লিটন…ভরসার তালিকা থেকে একে একে মুছে গেছে নামগুলো।
শেষ দিকে এসে রোমাঞ্চ ছড়ানো এই টেস্টটা আজ (রোববার) বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কোনোভাবে জিতে গেলে অনেক প্রশংসা হতো, চারিদিকে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের স্তুতি হয়তো ঝরত। কিন্তু তারকা ক্রিকেটারদের অনেককে দেশে রেখে বাংলাদেশ সফরে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুই টেস্টের সিরিজে যখন বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ হয়, বাংলাদেশের টেস্ট খেলার মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেই।
প্রায় দশ মাস পর বাংলাদেশের টেস্ট খেলতে নামা, করোনার বিরতি কাটিয়ে প্রথম সিরিজ খেলতে নামাও হয়তো সেখানে কারণ দর্শানোর নিক্তিতে যথেষ্ট হয় না। অথচ চতুর্থ দিনে আজ মধ্যাহ্নবিরতির পর মাত্র ২৯ বলে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ ৪ উইকেট ফেলে দেয় বাংলাদেশ, মাত্র ১১৭ রানে অলআউট করে দেয় ক্যারিবীয়দের।
মনে হচ্ছিল, বুঝি চট্টগ্রামের প্রায়শ্চিত্য মিরপুরে এসে করতে পারবে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে চারদিন দাপট দেখিয়ে উপমহাদেশে রেকর্ড লক্ষ্য দিয়েও শেষ দিনে কাইল মেয়ার্সের অবিশ্বাস্য ইনিংসকে শুধুই ‘একদিনের বৈপরীত্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে বাংলাদেশ, এমনটাই তখন মনে হচ্ছিল।
যদিও রেকর্ড তখনই শঙ্কা জাগাচ্ছিল। মিরপুরে চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডই ১০১ রানের, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। বাংলাদেশ বাদ দিয়ে সব দলের হিসেব করলে মিরপুরে চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ২০৯ রানের, বাংলাদেশের বিপক্ষে যা করেছে ইংল্যান্ড। আর মিরপুর হোক বা পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে, চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ২১৫ রানের, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। ২৩১ রান তাড়া করতে গেলে সে ক্ষেত্রে রেকর্ডই নতুন করে লিখতে হতো বাংলাদেশকে।
তামিম ইকবাল আর সৌম্য সরকারের উদ্বোধনী জুটিতে সে সম্ভাবনা ভালোভাবেই জেগেছিল। ১৪ ইনিংসে প্রথমবার পঞ্চাশ পেরিয়েছে বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি। সৌম্যর (১৩ রান) বিদায়ে ৫৯ রানে উদ্বোধনী জুটি ভাঙে, কিন্তু অন্য প্রান্তে আগ্রাসী তামিম যেন চতুর্থ দিনেই বাংলাদেশকে জিতিয়ে দেওয়ার পণ করে নেমেছিলেন! তাঁর ‘ওয়ানডে গতির’ ব্যাটিং দেখে তেমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক! টেস্ট ক্যারিয়ারের ২২তম ফিফটিতে তামিম পৌঁছেছেন ৪৪ বলে, ৯ চারে।
কিন্তু তখন কে জানত, সৌম্যর বিদায়ে আসলে বাংলাদেশের ইনিংসে মড়ক লেগেছে। এমন নয় যে পিচে খেলার অসাধ্য টার্ন বা বাউন্স আছে। রাকিম কর্নওয়াল মাঝে মাঝে বাড়তি বাউন্স পাচ্ছেন, কিন্তু সেটির চেয়েও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পুরোনো রোগই ভোগাল বেশি। ওই যে, উইকেট দেওয়ায় ‘হাতেম তায়ী’ বনে যাওয়া। কবিতায় কামিনি রায় ‘পরের কারণে স্বার্থ দেওয়ার’ কথা বলেছিলেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও এক অর্থে তা-ই করেছেন সিরিজজুড়ে। আনকোরা উইন্ডিজের তরে উইকেট দিয়ে এসেছেন।
তামিমকে দিয়ে শুরু। ১৩তম ওভারে সৌম্য আউট হওয়ার পর যেখানে নতুন ব্যাটসম্যানকে পথ দেখাবেন, তা না, ২৫ বল পর তামিম ক্যাচ প্র্যাকটিস করিয়ে এলেন। সিরিজজুড়ে ব্যর্থতায় দলে নিজের অন্তর্ভুক্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া নাজমুল হোসেন স্কোরারদের বেশিক্ষণ বিরক্ত করলেন না। চা-বিরতির আগে শেষ বল বনে যাওয়া রাকিম কর্নওয়ালের হঠাৎ বাউন্স পাওয়া ডেলিভারিতে যখন শর্ট লেগে ক্যাচ দিলেন নাজমুল, তাঁর নামের পাশে রান ১১।
চা-বিরতির পর ইনিংসের গল্পটা ছিল এরকম যে, একটা জুটি কিছুক্ষণ টিকবে, বাংলাদেশের আশা বাড়বে, তখনই জুটিটা ভেঙে যাবে। শুধু জুটিই ভাঙবে না, জোড়া ধাক্কাই লাগবে। মুমিনুল-মুশফিকের জুটি দিয়ে শুরু। চা-বিরতির পর দুজনে দলের রান ১০০ পার করে দিলেন। বাংলাদেশ তখন মুশফিক-মুমিনুলের ৫৩ বলে ২৩ রানের জুটিতে ভরসা মানছে। কিন্তু ওয়ারিক্যানের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে মুশফিক ফিরলেন, ঠিক ১৮ বল পর ফিরলেন মিঠুনও। দলের রান তখন ৫ উইকেটে ১১৮।
এরপর লিটন আর মুমিনুলে ভরসা করার পালা। ষষ্ঠ উইকেটে দুজনে ক্রিজে কিছুক্ষণ সময় কাটালেন, কিছু রান এল। কিন্তু ৪৭ বলে ৩২ রানের জুটিটা ভাঙল মুমিনুল আউট হওয়ায়। ১৯ বল পর ফিরলেন লিটনও। তখনো ৭৮ রান বাকি বাংলাদেশের।
তখন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে শুধু মেহেদি হাসান মিরাজই বাকি। শেষ ৩ ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ৭৮ রান করা চাট্টিখানি কথা তো নয়! মিরাজের কৌশল যদিও একটু ধন্দে ফেলেছে তখন। নিজের চেয়ে বেশি বল খেলতে দিচ্ছিলেন অন্য ব্যাটসম্যানদেরই!
অষ্টম উইকেটে তাইজুলের সঙ্গে মিরাজের ২৯ বলে ১০ রানের জুটি, তাতে ২৫ বলে ৮ রান তাইজুলের। নবম উইকেটে নাঈম হাসানের সঙ্গে জুটি হলো ৩৪ বলে ২৫ রানের, সেখানে ২০ বলে ১৪ রান নাঈমের! এর মধ্যে আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েইট এসে টানা দুটি বাই চার দিয়েছেন। যদিও সে দুটি ছিল ফাঁদে ফেলার চেষ্টা। যেটিতে পরে সফলও হয়েছেন ব্রাথওয়েইট। ১৮৮ রানে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে নাঈম আউট হওয়ার সময়ও মিরাজের রান ৩২ বলে ৫!
শেষ উইকেটে আবু জায়েদ আসার পরই বরং দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নেন মিরাজ। শেষ উইকেট হওয়ায় দিনে ওভারের সংখ্যা বাড়ানো হলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ১ উইকেট, বাংলাদেশের ৪৩ রান— এই সমীকরণে এসে জ্বলে উঠলেন মিরাজ। কর্নওয়ালকে এগিয়ে এসে দুটি ছক্কা মারলেন, তিনটি চারও মারলেন। এর মধ্যে পরপর দুই ওভারে একটি করে চার ও ছক্কা। বাংলাদেশের রান ২০০ পেরোল। খেলায় তখন টানটান উত্তেজনা।
বাংলাদেশের প্রয়োজন ধীরে ধীরে নেমে আসছে— ৩৯, ২৯, ১৮….। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের তো তখন শুধু একটা ভালো বলেরই অপেক্ষা। সেটি এল ওয়ারিকানের হাতে। ইনিংসের ৬২তম ওভারের তৃতীয় বলে। স্লিপে ক্যাচ উঠল মিরাজের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে। ৫৬ বলে ৩১ রান করে মিরাজ আউট। রোমাঞ্চের শেষ বাংলাদেশের ধবলধোলাইয়ের লজ্জায়!