সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে ২৫ বছর থেকে ৩৫ বছরের তরুণরা মারা যাচ্ছেন। ২০২০ সালে আক্রান্ত ও মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে ৪৫ শতাংশের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। করোনায় আক্রান্তের আগে এদের অনেকের শরীরে কিডনি, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা ও ডায়াবেটিক রোগ ছিল।
সেই তুলনায় তরুণ প্রজন্মকে এতদিন মোটামুটি সুরক্ষিত ভাবা হলেও এখন বাস্তবতা ভিন্ন। তরুণরা এখন ব্যাপকভাবে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মারাও যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গতবারের করোনাভাইরাসের ধরনে বদল ঘটেছে। আর সে পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে তরুণ সমাজও করোনার মরণ কামড় থেকে নিরাপদ নয়। ইমিউনিটি সক্ষমতা থাকলেও করেনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের কাছে ধসে পড়ছে প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
আইইডিসিআর’র পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশই তরুণ-মধ্যবয়সী। তারা বলছেন, দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এমনটি হচ্ছে। আগে ১ জন থেকে ১০ জন সংক্রমিত হলেও এখন ভ্যারিয়েন্টের কারণে ১ জন থেকে ১৬ জন আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ‘করোনার টার্গেট এবার তরুণ প্রজন্ম। এতদিন দেখা যাচ্ছিল বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন করোনা সংক্রমণে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে যারা মারা যাচ্ছেন; তাদের মধ্যে বেশিরভাগই কম বয়সী তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মই এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির কারণ। এ ভাইরোসের সংক্রমণ থেকে ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশ বয়ষ্ক ব্যক্তিরা আর নিরাপদ নন।
প্রশ্ন উঠেছে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হঠাৎ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের নেপথ্য কারণ কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার জন্য করোনাভাইরাস প্রতিনিয়ত বদল হওয়া দায়ী। তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতার অভাবের বিষয়টিও রয়েছে। তরুণরা দেখছে, মূলত বয়স্করাই বেশি মারা যাচ্ছেন। সে কারণেই তারা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করছেন তারা। তার মূল্য দিতে দিতে হচ্ছে অনেককে জীবন দিয়ে।
এতকিছুর পরও রাস্তায় দেখা যায়, অনেক তরুণ এখনো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের কারো মুখে হয়তো মাস্ক আছে। আবার কারো নেই। কেউ আবার মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। মাস্ক দিয়ে শুধু থুঁতনি ঢেকে রেখেছেন। নাকমুখ খোলা। উদাসীনতার নামে এই স্মার্টনেস ডেকে আনছে ভয়াবহ বিপদ।
তরুণদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের অধ্যাপক মনজুর রহমান বলেন, তরুণরা দলবেঁধে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গেছে। কে না জানে, এবার অধিকাংশ সংক্রমণ হয়েছে কক্সবাজার থেকে। দেশের তরুণ প্রজন্মের অবহেলা, সরকারের শিথিলতায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে তো বাড়ছেই। যার অনিবার্য ফল হিসেবে বর্তমানে একটা ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে তরুণ প্রজন্মসহ গোটা দেশ।
এ বিষয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের পরিবারের কাঠামোর জন্যও তরুণ প্রজন্মের বেশি হারে সংক্রমণ ঝুঁকির কারণ। বাংলাদেশে অনেক পরিবার এখনো বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই মিলে একসঙ্গে থাকেন। দুই ভাই বা দুই বোন একরুমে থাকেন। স্বভাবতই তরুণদের কেউ বাইরে আক্রান্ত হলে সে বাড়ি গিয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত করছেন।
অধ্যাপক ফরহাদ মনজুর বলেন, যে কোনো মৃত্যুই বেদনার। এর মধ্যে তরুণ বয়সীদের মৃত্যু আরও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তরুণদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে তরুণ প্রজন্মের আরও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। নিজে সুরক্ষিত থেকে পরিবারের অন্যকেও সুরক্ষা দেবেন তারা, এটাই প্রত্যাশা।
মনোচিকিৎসক অধ্যাপক মুহিত কামাল মনে করেন, ইদানীং তরুণদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এটার কারণ, ওদের চলাফেরায় বেপরোয়া ভাব রয়েছে। তরুণরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছে। তারা ধরেই নিয়েছে, করোনা বেশি বয়সীদের হয়। আগের করোনার উপসর্গ আর বর্তমান ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
ডা. জোবায়ের আহমেদ বলেন, বর্তমান ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ধনী-গরীব-যুবক-বৃদ্ধ কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এর সংক্রমণ। তাই সবাইকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বাসার বাইরে বা জনসমাগম হয় এমন স্থানে যাওয়া যাবে না। সামান্য জ্বর-সর্দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজন মনে করলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাছাড়া সবাইকে নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সরকারও তরুণদের নিয়ে উৎকণ্ঠিত। তাই প্রথমদিকে করোনার টিকা গ্রহণের বয়সসীমা ৪০ বছর থাকলেও ৭ জুলাই তা কমিয়ে ৩৫ বছর করা হয়। পরে আবার সেটা কমিয়ে ৩০ বছর করা হয়। চলতি বাস্তবতায় তরুণদের বিষয়টা মাথায় রেখে, করোনা টিকা গ্রহণের বয়সসীমা ১৮-তে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।