ভারতের ক্ষমতাসীন দলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মুসলিম সংসদ সদস্য নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বিজেপির বর্ষীয়ান মুসলিম নেতা মুখতার আব্বাস নাকভি পদত্যাগের ফলে এমন দৃশ্যই সামনে এলো। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় আর কোনো মুসলিম মুখ থাকল না। যখন হিন্দু বাদে মুসলিমসহ অন্যান্যদের মধ্যে বিজেপির প্রভাব বিস্তারের কথা বলছেন মোদি, সেই সময় তৈরি হলো এই পরিস্থিতি।
বৃহস্পতিবার রাজ্যসভার সংসদ সদস্য পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন বুধবার পদত্যাগ করেন সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী নাকভি। ৬৪ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ বিজেপির একমাত্র মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন, যে দলটির প্রায় ৪০০ সংসদ সদস্য রয়েছে।
ভারতে প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের আবাসস্থল। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার বসবাস দেশটিতে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজেপি তার একজন কর্মকর্তার বিতর্কিত ইসলাম বিরোধী মন্তব্যের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের মধ্যে ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নাকভিকে বিবেচনা করতে পারে। অবশ্য বিজেপির দলীয় হাইকমান্ড ও নাকভির পক্ষ থেকে এখনো সংবাদমাধ্যমকে এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
ভারতের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কাইয়া নাইডুর মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১০ আগস্ট। আর ৬ আগস্ট দেশটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। চলতি মাসের ২৫ তারিখ মেয়াদ শেষ হচ্ছে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের। তার বিদায়ের আগে, ১৮ জুলাই হবে ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ওড়িষার বিজেপি নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মুর নামও ঘোষণা করেছে দেশটির কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটি।
ভারতের সংবিধানে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রধানত আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করে। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী।
মোদির বিজেপি ‘বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ বলে দাবি করে। দলটির সংসদের নিম্নকক্ষে ৩০১ জন সদস্য রয়েছে যারা সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। নাকভির বিদায়ের ফলে সংসদের উচ্চকক্ষেও কোনো মুসলিম সদস্য রইল না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপির নির্বাচিত পদে মুসলিম প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি দলটির বারবার বলা ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ স্লোগানের বিরোধিতা করে।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরতি আর জেরাথ আল জাজিরাকে বলেছেন, এটি নতুন ও অস্বাভাবিক। তাদের কাছে এখন আর কোনো প্রতীকী মুসলিম মুখও রইল না। মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীনে বিজেপি এখন কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে বেশ খোলাখুলি দলটি বলে দিচ্ছে যে, আমরা দেখিয়েছি মুসলিমদের সমর্থন ছাড়াই আমরা নির্বাচনে জয়ী হতে পারি।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে, বিজেপি সাতজন মুসলমানকে প্রার্থী করেছিল কিন্তু সেই বছর ভোটারদের মধ্যে মোদির প্রতি অপ্রতিরোধ্য সমর্থন সত্ত্বেও তাদের কেউই জয়ী হয়নি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে যেখানে মোদি আরও ভালোভাবে ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। সেই নির্বাচনে বিজেপি ছয়জন মুসলিমকে প্রার্থী করেছিল, কিন্তু তারা আবার হেরেছিল।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ। এ রাজ্যের জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ মুসলিম। এই বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে একজন মুসলিমকেও প্রার্থী না করে বিজেপি তার ২০১৭ সালের কৌশলের পুনরাবৃত্তি করেছে। মণিপুর ও উত্তরাখণ্ড রাজ্যের নির্বাচনেও দলটি একই কাজ করেছে।
বিজেপির সংখ্যালঘু শাখার প্রধান জামাল সিদ্দিকী আল জাজিরাকে বলেছেন, দল তাদের প্রার্থী বাছাই করার সময় ধর্মকে বিবেচনায় নেয় না। দল প্রয়োজন অনুসারে আসন বরাদ্দ করে এবং লোকেরা যদি এটিকে ধর্মের চশমা দিয়ে দেখে তবে এটি সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ গেল মার্চে মুসলিমদের প্রার্থীদের তালিকা থেকে দূরে রাখার কারণ হিসাবে ‘নির্বাচনে জয়লাভ’-কে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জয়লাভের ভিত্তিতে আমাদের টিকিট বণ্টন হয়।
আরতি আর জেরাথ বিজেপির এই যুক্তির সাথে একমত। তিনি বলেন, দলটি মনে করে একজন মুসলিম বিজেপির টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সেই আসন জেতার ভাল সুযোগ নেই। বিজেপির মূল ভোটাররা মূলত কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভোটার। তারা একজন মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দিতে দ্বিধা করেন।
নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের একজন ফেলো রাহুল ভার্মা বলেছেন, কোনো মুসলিম এমপি বা বিধায়ক না থাকায় বিজেপির নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘ক্ষতির সম্ভাবনা নেই’। কিন্তু দলটির এ বিষয়ে গর্ব করা উচিত হবে না। বরং বিজেপি জাতীয়ভাবে প্রভাবশালী দল হওয়ায় তার সংগঠনে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকে আইনসভা ও মন্ত্রিত্বের পথ তৈরি করে দিতে হবে।
মুখতার আব্বাস নাকভি
প্রধানমন্ত্রী মোদির হাতে বুধবার পদত্যাগপত্র তুলে দেন নাকভি। পদত্যাগের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মোদি তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি দেশের সেবায় যে অবদান রেখেছেন, সেই কথা মনে করিয়ে দেন। মোদি প্রশংসা করলেও নাকভিকে এবার আর রাজ্যসভার টিকিট দেয়নি বিজেপি। মোদির মন্ত্রিসভায় এ নিয়ে তিনি দু’বার মন্ত্রিত্ব করলেন। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার সঙ্গেও নাকভি বৈঠক করেন।
বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা মুখতার আব্বাস নাকভি ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্র উত্তর প্রদেশের রাজনীতিক। গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় তার। ১৯৭৫ সালে ভারতে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হন তিনি, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর।
পরে জেল থেকে বেরিয়ে উত্তর প্রদেশের আঞ্চলিক দল জনতা পার্টিতে যোগ দেন নাকভি, সেখান থেকে বিজেপিতে আসেন। ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিজেপির সাবেক শীর্ষ নেতা ও ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর পদ পেয়েছিলেন তিনি।
তারপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলেন নাকভি।
জেএন/এমআর