মজুরি বাড়ানোর দাবিতে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে চার দিন কর্মবিরতি পালন করেছেন চা শ্রমিকেরা। কিন্তু দাবি আদায় না হওয়ায় আগামীকাল শনিবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নৃপেন পাল এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
নৃপেন পাল বলেন, ‘প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও দীর্ঘদিন ধরে দেশের চা শ্রমিকেরা মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এছাড়া দুই বছর পর পর শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক পক্ষের চুক্তি হয়। কিন্তু বিগত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে ১৯ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও নতুন চুক্তি করছে না মালিক পক্ষ। গত মাসে মালিক পক্ষ আমাদেরকে ১৪ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা সেটি প্রত্যাখ্যান করে গত মঙ্গলবার থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে চার দিন কর্মবিরতি পালন করেছি। এতে মালিক পক্ষের কোনো সাড়া পাইনি। তাই আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাগানে কাজ করা বন্ধ ঘোষণা করেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত শ্রমিকেরা বাগানে ফিরবে না। প্রয়োজনে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দেব।’
হবিগঞ্জের ২৪টি বাগান নিয়ে লস্করপুর ভ্যালি। এখানে মোট চা শ্রমিক রয়েছেন ৩৫ হাজার। এর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ২৭ হাজার এবং অস্থায়ী ৮ হাজার।
আমু চা বাগানের শ্রমিক মিনতি সন্তুবায় বলেন, ‘আমরা সারা দিন চা বাগানে কাজ করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পাই। যা দিয়ে দুই কেজি চালও কিনতে পারি না। এক লিটার তেলের দাম ২০০ টাকা। ছেলেমেয়ে সাধ-আহ্লাদও পূরণ করতে পারি না। মা বাবা হয়ে যদি ছেলে মেয়ের সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে না পারি তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কী? এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।’
বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, ‘দেশে সব জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। অথচ চা শ্রমিকেরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে ১২০ টাকা মজুরি পায়। দুই কেজি সবজি কিনতেই এই টাকা চলে যায়। তাই শ্রমিকদের বাঁচানোর স্বার্থে মজুরি ৩০০ টাকা করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু মালিক পক্ষ কোনো সাড়া দিচ্ছে না।’
চান্দপুর বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সাধন সাওতাল বলেন, ‘চা শ্রমিকেরা দেশের ভোটার হয়েও অবহেলিত। মৌলিক অধিকারও তাঁদের ভাগ্যে জোটে না। এছাড়া রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দিনে মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। এভাবে আমরা চলতে পারছি না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে বাগান বন্ধ করে দিয়েছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাগানে ফিরব না।’
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালি কার্যকরী পরিষদের সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, ‘আজকেও সিলেট জেলার চা বাগানগুলোতে ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করা হয়। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আগামীকাল শনিবার থেকে সিলেট জেলার ২৩টি চা-বাগানের শ্রমিকদের পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে।’
চা শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দের বলেন, সারা দেশের ন্যায় মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালনের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।
অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক চা শ্রমিকদের
মনু-দলই ভ্যালীর সভাপতি ধনা বাউরী জানান, আগামীকাল শনিবার থেকে বাংলাদেশের সকল চা বাগানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালীর সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, ‘আমাদের চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও মালিকরা চুক্তি ভঙ্গ করছেন।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দী বলেন, ‘চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিনের। প্রতি বছর মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও গত ৩ বছর ধরে মজুরি বাড়ানো হচ্ছে না। চুক্তির নির্দিষ্ট সময় থেকে এরই মধ্যে ১৯ মাস চলে গেছে। তাই আমাদের বাধ্য হয়ে কঠোর আন্দোলনের যেতে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন চট্টগ্রাম ভ্যালীর সভাপতি নিরঞ্জন নাথ মন্টু বলেন, ‘বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে চা শ্রমিকের মজুরি ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে আমরা ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করে আসছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কর্ম বিরতি কর্মসূচি পালন করে যাব। এরপরও দাবি আদায় না হলে সামনে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, বর্তমানে দেশের ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ২১টি রয়েছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের ২১টি চা বাগানের মধ্যে শুধুমাত্র ফটিকছড়ি উপজেলাতেই রয়েছে ১৭টি চা বাগান। দেশের মোট চায়ের ১০ শতাংশ উৎপাদন হয় ফটিকছড়ির চা বাগান থেকে। এছাড়া বাশঁখালিতে একটি, রাঙ্গুনিয়ায় দুটি ও রাঙামাটিতে একটি রয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে মালিক পক্ষের অবস্থান জানান বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের সভাপতি জি এম শিবলী। তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনের ফলে মালিক-শ্রমিক উভয়ই লোকসানে পড়বে। আমরা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মজুরি যতটুকু নির্ধারণ করার তা করছি, এছাড়াও বাড়ি রেশনসহ বিভিন্ন সুবিধা তারা পাচ্ছে। এখন তাঁদের টাকা উপার্জনের সময় আন্দোলন করে তাঁরা তাঁদের ক্ষতি করছে।’
জেএন/কেকে