শিশুখাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সারাদেশে ভেজালের ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চার পাঁচ বা ছয়স্তর বিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী বা দুর্ভেদ্য গ্রিন জোনও এর আওতামুক্ত নয়। এক নীরব ঘাতক হয়ে জাতির ওপর খড়গ হয়ে দেখা দিয়েছে।

- Advertisement -

অবস্থার ভয়াবহতা এমন যে সচেতন থেকেও ভেজালের হাত থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কি খাবারে বিষ খাচ্ছি?

- Advertisement -google news follower

সম্প্রতি সময়ে শাকসবজি, মাছ-গোশত থেকে ফলমূল এমনকি বিশেষ করে নানা রকম নিম্নমানেরমানের ও ভেজাল শিশুখাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে শিশুস্বাস্থ্য উপর পড়ছে চরম ক্ষতিকর প্রভাব।

ফেরিওয়ালা থেকে দোকান সব জায়গায় নানা রঙের চিপস, চকোলেট। অভিভাবকরাও জানেন না, তারা শিশুদের কী খাওয়াচ্ছেন। শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একই সাথে বিভিন্ন প্রকার শিশু খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের ফলে জনস্বাস্থ্যের হুমকি।

- Advertisement -islamibank

অনুসন্ধানে জানা যায়, অল্পপুঁজিতে বেশি লাভের আশায় এক শ্রেণীর অর্থলোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব নকল ও ভেজাল খাদ্য শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

বিএসটিআই এর অনুমোদন হীন এ সব পণ্য দেশের বিভিন্ন বড়বড় শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে গুদামজাত করেন। পরে বিভিন্ন কৌশলে নানান লোভনীয় অপারে জেলা-উপজেলার হাট-বাজারে অতিআল্পমূল্যে বিক্রয় করে থাকে।

কোন কোন ব্যবসায়ী নামী-দামী দুই-একটি কোম্পানীর ডিলারশিপ গ্রহণ করে তার আড়ালে এ সকল ভেজাল খাদ্যদ্রব্য প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চালের হাট-বাজার ও দোকান-পাটে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে শিশুখাদ্যে আরো ভয়বহতার রুপ নিয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন শিশু খাদ্যের ভেজাল কারখানা।

যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে শিশু খাদ্য। আসল আর নকলের গায়ে একই লেভেল। সেজন্য চেনাও কঠিন। আসল পণ্যের পাশাপাশি নকল এসব ভেজাল খাদ্য ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে। এতে দারুণ দুশ্চিন্তায় এবং শিশুদের পছন্দের খাবার কিনতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন অভিভাবকরা।

ভেজালের কারণে খাদ্য-চিকিৎসার সাথে অন্য সব মৌলিক চাহিদাও কোন না কোন ভাবে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। চিকিৎসক ও গবেষকদের ভাষ্যমতে, অনেক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে খাদ্যে ভেজাল যা নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক চাপ পর্যন্ত সুবিস্তৃত।

জানা গেছে, রাজধানীর চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, কাপ্তান বাজার, সাভার, টঙ্গী, তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে শিশুখাদ্য উৎপাদনের শত শত ভেজাল কারখানা।

রাজধানীর চকবাজার থানার কামালবাগ এলাকায় সুভেল লজেন্স ফ্যাক্টরির, শহীদ ফুড ফ্যাক্টরি, কবির ফুড ফ্যাক্টরি ও আবির ফুড ফ্যাক্টরিসহ বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। যারা প্রত্যকেই শিশু খাদ্যে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ব্যবহার করে উৎপাদন করছেন। যা খেয়ে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও বিএসটিআই এর অভিযানে বেরিয়ে এসেছে শিশু খাদ্যে প্রতারণার আরো বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর রহস্য।

শিশুদের খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রং, কৃত্রিম ফ্লেভার, নিষিদ্ধ কেমিক্যাল, হাইড্রোজ, মোম ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুস এবং জেলিসহ ভেজাল খাদ্যপণ্য। আর এসব পণ্যের প্রধান গ্রাহক হচ্ছে শিশুরা। এগুলো খাওয়ার কারণে শিশুরা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, নিম্নমানের মুখরোচক ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। তাদের শরীরে এসব উপাদান স্লো পয়জনিংয়ের মতো কাজ করছে। মূলত দুইভাবে শিশুরা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করছে। এসব শিশুদের পেটে গেলে কিডনি ও লিভার ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

বিশেষ করে চকলেট, চিপস, ভেজাল জুসের কালার, বিভিন্ন প্রকার ভেজাল ফ্লেভার এবং ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবহারের মাধ্যমে ভেজাল জুস, বিস্কুট ও কেক প্রস্তুত করে, যা শিশুসহ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।

শিশুদের ভেজাল খাদ্য তৈরি কারখানা সম্পর্কে র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, নানা ধরনের শিশু খাদ্যপণ্যে ভেজাল দিচ্ছেন। ক্ষতিকর রং, হাইড্রোজ ও মোম দিয়ে খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। এ ধরনের তৈরি খাদ্য শিশুদের পেটে গেলে কিডনি ও লিভার ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।

তিনি বলেন, ফ্যাক্টরি ও খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ভেজাল চকলেট, জুস ও বিভিন্ন ভেজাল শিশুখাদ্য উৎপাদন করে আসছে। যাদের কোনো অনুমোদন নেই বিএসটিআইয়ের। নামমাত্র একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে এসব কারখানা।

সম্প্রতি রাজধানীর গাবতলীর আমিনবাজার এলাকায় ফ্রুটি নামক অনুমোদনবিহীন ও নকল জুস তৈরির অপরাধে শাপলা ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ফ্যাক্টরিসহ ২টি প্রতিষ্ঠানে র‍্যাব অভিযান পরিচালনা করে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং বিপুল পরিমাণ নকল জুস জব্দ করা হয়।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমিনবাজার এলাকায় ফ্রুটি নামক নকল জুস প্রস্তুতকারী ‘শাপলা ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ’ তাজমহল ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে অভিযান চালানো হয়।

প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নকল জুস তৈরি করত। অস্বাস্থ্যকরভাবে ভেজাল জুস, বিস্কুট ও কেক উৎপাদন করে বিক্রি করছে যা শিশুসহ মানুষের শরীরের জন্য ব্যাপক হুমকিস্বরূপ।

রাজধানীর কাপ্তান বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর একটি অভিযান পরিচালনা করেন। যেখানে শরবত, চিকেন গ্রিল, চিকেন ফ্রাই, শিক কাবাব, কাচ্চি বিরিয়ানি, চকলেট, আইসক্রিম, কেক, চানাচুরসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী তৈরিতে ফুড গ্রেড হিসেবে কাপড়ে ব্যবহূত রং ব্যবহার করার অপরাধে জরিমানা করেন।

জাতিসংঘ রেডিওর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব মতে, ভেজাল বা দূষিত খাবার খেয়ে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটাচ্ছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হচ্ছে পাঁচ বছরেরও কম বয়সি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক পরিচালক ড. কাযুয়াকি মিযাগিসিমা বলেন, যে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র নয় শতাংশ হলেও খাদ্য দূষণজনিত মৃত্যুর ত্রিশ শতাংশই তারা।

বাংলাদেশের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষণায় বলছেন, এখন প্রচুর পেটের পীড়ার শিশু রোগী পাওয়া যায়। যারা সরাসরি ভেজাল খাদ্যের জন্য আক্রান্ত হয়। এর বাইরেও ভেজাল খাবার শিশুদের নানাভাবে ক্ষতি করে থাকে।

খাবারে ক্ষতিকারক রঙের ব্যবহার, কীটনাশক ইত্যাদির কারণে শিশুর কিডনি ও লিভারসহ যেসব জায়গায় বেশি রক্ত চলাচল করে সেসব অঙ্গ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে। এর বাইরে পেটের পীড়া, পেটে ঘা, আলসার, চর্মরোগ ইত্যাদি প্রভাব তো খুব বেশি দেখায় যাচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন. খাদ্যপণ্য সংরক্ষণে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর ফরমালিন পদ্বতি, কার্বাইড পদ্বতি, কীটনাশক পদ্বতি আরো কত কি। সবগুলো পদ্বতির রয়েছে ক্যারিশমাটিক গুণ।

তাই এগুলো দেদারছে ব্যবহার হচ্ছে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় মৌসুমী ফল, শাক-শবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পণ্য, জিলাপি, ফার্স্ট ফুড, পশুখাদ্য, ওষুধ ইত্যাদিতে।

তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার ফলে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিকমুনাফা পেয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন। অন্যদিকে এ সব নকল খাদ্য খেয়ে শিশুরা দারুণ ভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিরমধ্যে পড়ছে।

ভেজাল ও নিম্নমানের শিশু খাদ্যে উৎপাদন ও বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে শিশু খাদ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ বা মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুমন বিশ্বাস।

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM